অম্বরীশ ভট্টাচার্য
শৈশব থেকেই সব চেয়ে প্রিয় অভিনেতা বলতেই মনে পড়ে নাসিরুদ্দিন শাহকে। তবে কৈশরের ডানা গজাতেই যাঁর টানে বারবার প্রেক্ষাগৃহে ছুটে গিয়েছি, তিনি অমিতাভ বচ্চন। ওঁর 'হম', 'অকেলা', 'আখরি রাস্তা' আমরা ব্ল্যাকে টিকিট কেটে দেখেছি। তখন মাল্টিপ্লেক্স ছিল না। এসির আরাম, মিষ্টি পপকর্নের মন মাতানো সুবাস, এ সবই যেন আকাশকুসুম! কাঠের শক্ত চেয়ারে বসে আলো-আঁধারি হলের পর্দায় দেখতাম ওঁকে। আর অবাক হতাম। জীবনের সব না-পাওয়া, গ্লানি, ব্যর্থতাগুলো যেন মিলিয়ে যেত কোনও জাদুকাঠির ছোঁয়ায়।
এর পর আমার বয়স বাড়ল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উনিও নিজেকে বদলালেন। ওঁকে দেখলাম 'ব্ল্যাক', 'মহব্বতে'র মতো অন্য ধারার ছবিতে। তখনও টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছি, হলে গিয়ে সিটি বাজিয়েছি।
পেশা হিসেবে অভিনয়কে বেছে নেওয়ার পরেও কখনও ওঁর সঙ্গে কাজ করার স্বপ্ন দেখিনি। বলা ভালো দেখার সাহস করিনি। আমি আঞ্চলিক অভিনেতা। হিন্দি ভালো বলতে পারি না। 'বিগ বি'র মতো শিল্পীর সঙ্গে পর্দা ভাগ করব? এও আবার হয় নাকি! কিন্তু হঠাৎ এক দিন তা-ই হল! একটা ফোন কল বদলে দিল সব কিছু। আমার না-দেখা স্বপ্ন পূরণ হল নিমেষে।
২০১৮ সালে প্রদীপ সরকারের একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করার প্রস্তাব পেলাম। তাঁর সহকারী ফোন করে শ্যুটের দিনক্ষণ জানালেন আমায়। কিন্তু সে দিন একটি জরুরি কাজ থাকায় আমি শ্যুটের তারিখটি পরিবর্তনের অনুরোধ জানাই। যদিও তাতে তাঁরা রাজি হননি। জানানো হয়, যিনি আমার সঙ্গে শ্যুট করবেন, তার পক্ষে ওই দিন বাদে আর সময় দেওয়া সম্ভব নয়। কথাটি শুনে খানিক অবাক হয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, আমার সেই সহ-অভিনেতাটি কে। উত্তর এল দু'টি শব্দে। অমিতাভ বচ্চন।
প্রথমে কথাটা বিশ্বাস করতে খানিক সময় লাগে। আমি আর 'বিগ বি' এক পর্দায়? এও সম্ভব? এমন যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সব কাজ বাতিল করে পাড়ি দিলাম মুম্বই। প্রথমে ওঁর বডি ডাবল-এর সঙ্গে মহড়া হল। তার পর সেটে এলেন স্বয়ং 'বিগ বি'। উনি নিজেও কিছু ক্ষণ আমাদের রিহার্স করলেন। এবং যত বার ওঁর ভুল হয়েছে, কথা আটকেছে, উনি ততবার আমাদের 'সরি' বলেছেন। এত বড় তারকা হয়েও যে এমন অমায়িক হওয়া যায়, তা ওঁকে না দেখলে জানতাম না!
বিজ্ঞাপনের কাজ শেষ হওয়ার পর সাহস করে ওঁর কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম। বিগ বি-র পাশে গিয়ে বসেছিলাম। প্রথম প্রথম একটু ভয় করছিল বটে। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করে শেষমেশ কথা বলি। তার পর শুরু হল আড্ডা! উনি কলকাতা নিয়ে প্রচুর গল্প করেছিলেন! বলেছিলেন, কলকাতায় এলে রাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ঘুরে দেখেন প্রিয় শহরের রাস্তাঘাট। রবিবাবুকে (ঘোষ) উনি খুব শ্রদ্ধা করেন। এখনও শহরে এলে ওঁর বাড়িতে যান। ভাবতে পারিনি, এত বড় মাপের একজন মানুষ আমার সঙ্গে এত কথা বলবেন! সত্যিই অবাক হয়েছিলাম।
কাট টু ২০২২। আরও এক বার 'বিগ বি'র সঙ্গে কাজের সুযোগ এল। এ বারও বিজ্ঞাপন। ভেবেছিলাম, উনি আমায় চিনবেন না। আমি এগিয়ে গিয়ে নতুন করে নিজের পরিচয় দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই উনি আমায় থামিয়ে দিলেন। বললেন, উনি আমায় চিনতে পেরেছেন। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, চার বছর আগের সাক্ষাৎ আপনি মনে রেখেছেন? 'বিগ বি' যে উত্তরটা দিয়েছিলেন, তাতে অবাক এবং মুগ্ধ দুই-ই হয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন, 'আমার কাছে সব কাজেরই গুরুত্ব সমান। যদি আমি কোনও কিছু ভুলে যাই, তবে বুঝতে হবে, আমার কাছে সেই জিনিসটির কোনও গুরুত্ব নেই।'
আরও একটু সাহস করে ওঁর কাছে আরও একটি আবদার রেখেছিলাম। ওঁর মেক আপ ভ্যান দেখতে চেয়েছিলাম। উনিও এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। অতঃপর 'বিগ বি'র সম্মতিতেই আমার ইচ্ছা পূরণ হল। সেখানে বসেই ফের আড্ডা শুরু হয়েছিল ওঁর সঙ্গে! আমার সঙ্গে ওটিটি নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। শুধু তাই নয়! ওঁর নতুন আইফোন বার করে আমাকে দেখিয়েছিলেন। শিশুসুলভ উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছিলেন কোন কোন অ্যাপ ডাউনলোড করেছেন। এ সবই তখন স্বপ্নের মতো লাগছিল। তার পর মনে হল, এক জন প্রকৃত শিল্পী বোধ হয় এ রকমই হন। তারকা হয়েও থেকে যান মাটির কাছাকাছি।
কথার ফাঁকে পরম স্নেহে একটি কমলালেবু আমার হাতে দিয়েছিলেন। কমলালেবু রেখে দেওয়া যায় না। যদি যেত, রেখে দিতাম...