আরজি কর কাণ্ডে পর থেকে প্রতিবাদে পথে নেমেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁরা তাঁদের সেই আন্দোলনে পাশে পেয়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে তারকাদের। এক্ষেত্রে পূর্ণ সমর্থন নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে রয়েছেন সিনিয়র ডাক্তররাও। স্বাস্থ্যভবনের সামনে টানা অবস্থান বিক্ষোভের পর এই মুহূর্তে আরজি করে পালা করে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তারা। ডাক্তারদের এই আন্দোলনে মুখ হয়ে উঠেছেন কিঞ্জল নন্দা, অনিকেত মাহাতো, দেবাশিস হালদার, রুমেলিকা কুমাররা। যদিও তাঁরা নিজেরা নিজেদের আন্দোলনের মুখ, হিসাবে দেখতে নারাজ।
এদিকে সম্প্রতি নাম না করে কিঞ্জল নন্দাকে আক্রমণ করে ফেসবুকের পাতায় একটা পোস্ট করেন পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। তিনি লেখেন, ‘মগজ নিয়ে কিছু কথা। এক কোটি টাকা ডোনেশন দিয়ে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়েছেন জুনিয়র ডাক্তারদের বিপ্লবী মুখ। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।’
যদিও অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের এধরনের মন্তব্য ভালো চোখে দেখেননি বহু নেটিজেন। এমনকি বিষয়টা নিয়ে গর্জে ওঠেন অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীও। যিনি কিনা গোড়া থেকেই তিনি সাধারাণ মানুষের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন।অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের কথায় প্রশ্ন তুলে সুদীপ্তা লেখেন, 'হেলো Aniket দা! এই বিপ্লবে সেই প্রথম দিন থেকে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আছি আমি, অথচ আমি তো প্রাইভেট, পাবলিক, সরকারি কোনো মেডিকেল কলেজেই পড়িনি। ডাক্তারির 'ড' ও জানি না। একটা প্যারাসিটামল খেতে হলেও ডাক্তার কে জিজ্ঞাসা করে খাই। তাহলে আমার কি আর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লব করা হবে না? এ সমাজ কি আমাকে বা আমার বিচার চাওয়ার দাবি কে মেনে নেবে না?'
সুদীপ্তা আরও লেখেন, ‘সম্প্রতি আমরা সিনেমা, টিভি, ওয়েব ইত্যাদি তে কাজ করেন এমন মহিলাদের ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে আমাদের জন্য একটা ফোরাম তৈরি করেছি। সেখানে কেউ হয়তো কোনো সরকারি ফিল্ম স্কুল থেকে পাশ করা, কেউ বেসরকারি, আর বেশির ভাগই কোথাও থেকে পাশ টাশ করা নয় (যেমন আমি)। সেক্ষেত্রে কি আমরা আমাদের ইন্ডাস্ট্রি তে চলা অন্যায়ের (আপাতত শুধু মেয়েদের ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষের উপর)বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলতে পারি আদৌ? আমি নিয়মকানুন অত জানিনা। তুমি এত সিনিয়র এবং বিচক্ষণ, এত অভিজ্ঞতা তোমার, একটু যদি গাইড করে দাও ভালো হয়। উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো। পুণশ্চ : আমার বাবার নাম বিপ্লব। আমিও (তোমার মত) মনেপ্রাণে চাই বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’
সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কথায় পাল্টা উত্তর দিয়ে অনিকেত চট্টোপাধ্যায় আবারও তাঁর উদ্দেশ্যে লেখেন, ‘একজন নয়, অনেকজনই কোটি টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ম্যানেজমেন্ট কোটায় / এন আর আই কোটায় ভর্তি হয়ে ডাক্তার হয়, হবেন, হয়েছেন। বেশ করেছেন, এ দেশে যাদের টাকা আছে তারা বেশি সুবিধে পাবে, তারা বড় স্কুলে পড়তে পারবে, তারা ভাল খেতে পারবে, এটা স্বাভাবিক, শ্রেণী বিভক্ত সব রাষ্ট্রেই সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা এই ক্যাপিটেশন ফির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলাম, সুদীপ্তা, তোর বাবা বেঁচে থাকলে জেনে নিতে পারতিস। আমরা বলেছিলাম, চিকিৎসা শাস্ত্রের মত এক উচ্চ শিক্ষায় মেধার ভিত্তিতে নয়, টাকার ভিত্তিতে ভর্তি হওয়া এক মারাত্মক সিদ্ধান্ত, আমরা তার বিরোধিতা করি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পেশার শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্যাপিটেশন ফি বাতিল করো। হ্যাঁ এটাই ছিল সেদিন বামপন্থী প্রত্যেক দলের সিদ্ধান্ত। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেটা এখনও বিশ্বাস করি। এখন প্রশ্ন হল সেই সাধারণ বিরোধিতা কেবল মাত্র ক্যাপিটেশন ফির মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ? কারণ প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। কারণ তিলোত্তমার মৃত্যুর পরে দুটো সমান্তরাল আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যার একটায় আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। সেটা হল মহিলাদের স্বাধীনতার লড়াই, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই, জেন্ডার ইকুয়ালিটির জন্য লড়াই এবং সেই লড়াই এর একটা দাবী তিলোত্তমার ধর্ষণ হত্যার ন্যায় বিচার। পরোক্ষভাবে হলেও রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম দূর্নীতিও তার জন্য দায়ী অতএব তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এই আন্দোলনের এক অঙ্গ। অন্যদিকে এই ধর্ষণ আর হত্যার প্রেক্ষাপটেই দ্বিতীয় আন্দোলনটা হল জুনিয়র ডাক্তারদের, তাঁরাও তাঁদের সতীর্থের নৃশংস ধর্ষণ আর খুনের প্রতিবাদ করছেন, তার পাশাপাশি তাঁদের সুরক্ষার প্রশ্নও তাঁরা তুলেছেন, তাঁদের আরও কিছু দাবি আছে যা রোগীদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। এই দুই সমান্তরাল আন্দোলন কখনও কখনও এক জায়গায় মিলেছে, কিন্তু যখনই প্রশাসনিক ভাবে আন্দোলন নিয়ে কথা হয়েছে তখনই তাতে প্রথম আন্দোলনের কেউই ছিলেন না, বরং বলা যায় প্রথম আন্দোলনের ধারাটা আলাদা হয়ে গেছে, যা হতে পারতো এই মূহুর্তে সবথেকে বড় আন্দোলন, নারী সুরক্ষার আন্দোলন, লিঙ্গ সাম্যের আন্দোলন। এটা দুর্ভাগ্যজনক।’
অনিকেত চট্টোপাধ্যায় আরও লিখেছেন, ‘যাবতীয় আলোচনা, বৈঠক, দাবি দাওয়া, যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা, তাঁদের চার্টার অফ ডিমান্ড এ অনুপস্থিত নারী সুরক্ষার কথা, লিঙ্গ সাম্যের অধিকারের কথা। তাঁদের ৩/৫/৭ দফা আন্দোলনের মধ্যে সেসব কথা নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে এক সামাজিক আন্দোলন হয়ে উঠল মাত্র জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন। কিন্তু সেখানেও তো একটা আশা ছিল, এই জুনিয়র ডাক্তারেরা কমিউনিটি হেলথ এর কথা বলবেন, গণ স্বাস্থ্যের কথা বলবেন। বলবেন কেন গত ১১/১২ বছরে স্বাস্থ ক্ষেত্রে ৮ গুণ বেশি পুঁজি ঢালা হয়েছে? কাদের মুনাফার জন্য ঢালা হয়েছে? কাদের স্বার্থে ঢালা হয়েছে? কেন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেবল হাসপাতাল আর বড় বড় যন্ত্রপাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ, কেন প্রাইভেট কর্পোরেট সেক্টরে চিকিৎসা এখন এক ফাইভ স্টার হোটেল হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই হাজারো প্রশ্ন কিন্তু ডাক্তারদের আন্দোলনের কোথাও নেই? নেই জেনেরিক ওষুধ আর ডায়গোনেস্টিক ঘাপলাবাজির কথা। তার মানে তাঁরা কাউকে আড়াল করতে চাইছেন? তাঁরা গণ স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত নন কেবল নিজেদের সুরক্ষা চাইছেন? এবং যখন এই আলোচনার পরিসরে আমরা চলে যেতে বাধ্য হই, এখন এই আন্দোলন জুনিয়র দাক্তার, সি বি আই তদন্ত আর সুপ্রিমকোর্টের বিষয়, উবেই গেছে গণস্বাস্থ্যের কথা যে গণস্বাস্থের কথা আমরা বহুকাল বলেছি আর তার যুক্তি যুগিয়েছিলেন ডঃ পূণ্যব্রত গুন, যিনি এখন এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তখন বুঝি আবার এক মরীচিকার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের। আবার আন্দোলনের শেষে মানুষের হাতে পড়ে থাকবে পেনসিল। হ্যাঁ সেই জন্যেই আন্দোলনের মধ্যে আসুক গণস্বাস্থ্যের কথা, আসুক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে শ্লোগান। তারবদলে সেই স্বাস্থ্য মাফিয়াদেরই দেখলাম আন্দোলনের মুখ হয়ে দাঁড়াতে। এই কথাগুলো বলার পরে তোর প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিই। আমার কোন লেখায় বলেছি যে এই আন্দোলনটা করতে হলে, আন্দোলনে নামতে হলে ডাক্তার হতে হবে? মেডিকেল কলেজেই পড়তে হবে? বরং এই বিরাট সামাজিক আন্দোলনটা কেবল ডাক্তারবাবুদের সুরক্ষার আর তাদের সঙ্গেই সরকারের প্রধানদের বৈঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবার বিরোধিতা করছি মাত্র। দুই, টলিপাড়ায় তোদের ফোরাম নিয়ে আমার খুব বেশি কিছু জানা নেই। তবে ওখানে যে অন্যায় চলে, চলে আসতো, সেটাই তো আমার প্রথম ছবির বিষয় ছিল। কিন্তু গত চার পাঁচ বছর ধরে ঐ টলিপাড়ার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কই নেই। কিন্তু তোদের উদ্যোগের জন্য আগাম সমর্থন জানিয়ে রাখলাম। আবার তার মানে এও নয় যে সেখানে যা যা হবে সবটাকেই সমর্থন জানাবো, সাধারণ মানুষের জন্য, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য, ঠকে যাওয়া মানুষের জন্য যেটুকুই করবি, তাই ভালো, তাদের পাশে থাকার কথা বলছিস, এটাই তো বড় কথা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে দ্বিচারীতাই প্রথম আর প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভালো থাকিস।’
এদিকে আবার অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের কথার উত্তর দিয়েছেন কিঞ্জল নন্দাও। কিঞ্জল লেখেন, ‘ইচ্ছে হল তাই লিখছি। অনেকেই অনেক কথা বলছেন, সত্য়িটা একটু বলা উচিত। যেহেতু অনিকেতবাবুকে আমি কিছুটা চিনি। আর উনি আমার সিনিয়র। সেই জায়গা থেকে শ্রদ্ধা জানিয়েই লিখছি। আমি যে বছর WBJEE দি, সেবছর আমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলে টোটাল সিট ছিল ৯০০র কাছাকাছি। তখন এত মেডিক্যাল কলেজ হয়নি। আমি র্যাঙ্ক করেছিলাম ৮৫৯ (জেনারেল)।কিছুটা শেষের দিকে জেলার কিছু মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছিলাম। কিন্তু যেহেতু বাবা-মা একা থাকেন, আমি বাইরে যেতে চাইনি। বরাবরই আমি ঘরকুনো। তারপর কাউন্সিলিংয়ে আমি কেপিসিতে পাই। তখন কেপিসিতে গর্ভমেন্টের ৫০টা সিট ছিল। তারমধ্যে আমি প্রবেশ করি ৫.৬। ইয়ারে আমার খরচ হয়েছিল ৫ লক্ষ। বিশ্বাস করুন, এই টাকা আমি বাবার থেকে নিইনি। নিজে ব্যাঙ্ক থেকে লোন করেছিলাম। বাকিটা আমি টিউশন করতাম কেমিস্ট্রি ও ম্যাথ। বাবার শিক্ষা তো এমনই ছিল, যে বড় হয়েছো, নিজের খরচ নিজে চালাও। তাই হয়ত পড়াশোনা, টিউশন ও থিয়েটার নিয়েই থাকতাম। ডাক্তারি পাশ করার পর নিজে কাজ করি, সততার সঙ্গে পয়সা রোজগার করে লোন শোধ করেছি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের SBI ব্রাঞ্চ, খোঁচ নিলে জানতে পারবেন। আপনি পরিচালক, খুব নমনীয় ব্যক্তি, সাধারণ জীবনযাপন করেন, তাই আপনার কাছ থেকে একটু সত্যতা আশা করি। কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করবেন। শ্রদ্ধা নেবেন। আমার বাবা-মা জীবনে একটাই জিনিস শিখিয়েছেন মানুষ হতে।’
অনিকেতের পোস্টের নিচে কিঞ্জল নন্দার উত্তরের স্ক্রিনশটটা অবশ্য দিয়েছেন কেয়া মুখোপাধ্যায় নামে এক নেটিজেন। তিনি অনিকেতবাবুর মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে লেখেন, ‘আপনি নির্দিষ্টভাবে যাঁর উদ্দেশে লিখেছিলেন, তিনি আপনার পোস্টে উত্তর দিয়েছেন। এখানে সেটা তুলে দিলাম। প্ররোচনামূলক মিথ্যাচারের জন্য ক্ষমা চাইবেন কি, Aniket Chattopadhyay?’ তবে শুধু কেয়াদেবীই নন, কিঞ্জল নন্দাকে নিয়ে নাম না করে হলেও এধরনের মন্তব্য ভালোভাবে নেননি বহু নেটিজেন।