যার হাত একবার আমরা ছেড়ে আসি, ওই কাগজে কলমে সম্পর্ক চুকিয়ে আসি যার সঙ্গে তার সঙ্গে কি আর আমাদের কোনও যোগাযোগ থাকে না? মনের গভীরেও না। ছেড়ে আসা কি এতটাই সহজ, যে চাইলেই ছেড়ে আসা যায়। দিন, মাস, বছরের এত অভ্যেস চট করে ভুলে যাওয়া যায়? আইনত প্রাক্তন হাওয়াই যায় (প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মৌখিক), আর মনের টান? অনুভূতি? অভ্যাস? উত্তরটা বোধহয় কম বেশি আমাদের সবারই জানা। আর এই প্রত্যেক কটা উত্তর দেওয়ার বা নিদেনপক্ষে খোঁজার চেষ্টা করেছে ‘অর্ধাঙ্গিনী’। সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে আনতে যিনি সিদ্ধহস্ত সেই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় আবার তাঁর নতুন ছবি অর্ধাঙ্গিনীতে ছক্কা হাঁকালেন। সম্পর্কের নানা শেড, নানা দিক তুলে ধরলেন এই ছবিতে।
প্রাক্তন স্ত্রী এবং বর্তমান স্ত্রী- কে স্বামীকে কতটা ভালো জানেন, চেনেন, প্রাক্তন হলেই কি প্রাক্তন হওয়া যায় সবটাই যেন এই ছবির থেকে স্পষ্ট। এখানে তো বলেই দেওয়া হল যিনি প্রাক্তন তিনি হয়তো মানুষটাকে খুব ভালো করে চেনেন, বোঝেন, তাঁর প্রত্যেকটা স্বভাবের বিষয় ওয়াকিবহাল। কিন্তু যিনি বর্তমান তিনি তাঁর ভবিষৎ সহ বর্তমান জানেন। কোনটাকে অস্বীকার করা যায়? কোনটাকেই বা ছোট করা যায়? একই সঙ্গে এই ছবিতে উঠে এসেছে আরও বেশ কয়েকটা দিক। সন্তান হওয়া না হওয়ার সমস্ত দায়ভার যেন মহিলাদেরই। সমাজ এগোলেও, উন্নত হলেও কিছু পুরুষ নিজেদের অক্ষমতা মানতে পারেন না, দায়, দোষ সবটাই চাপান স্ত্রীদের উপর। বাদ দেন না অপমান, হেনস্থা করতেও। নিজেদের পৌরুষ প্রমাণ করতে বাকি রাখেন না কোনও কিছুই।
‘অর্ধাঙ্গিনী’ সুমন চট্টোপাধ্যায় (কৌশিক সেন), তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী শুভ্রা (চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়) এবং বর্তমান মেঘনা মুস্তাফি (জয়া আহসান) -কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। সুমন বাবা হতে অক্ষম, কিন্তু হলে কী হবে তিনি সেটা মানতে নারাজ। ফলে সংসারে নিত্যদিন অশান্তি, ঝামেলা। একটা সময় বাধ্য হয়ে তিনি এবং তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী আলাদা হয়ে যান। শুভ্রা তাঁর সাধের গোছানো সংসার অভ্যাস ছেড়ে চলে আসেন। তার কিছু পরেই সুমনের জীবনে আসেন বাংলাদেশি গায়িকা মেঘনা। মেঘনারও প্রাক্তন স্বামী প্রয়াত। কাছাকাছি আসেন তাঁরা। কিন্তু বাড়ির লোক সেটা মানেন না, মূলত ধর্মের কারণেই। ফলত বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন সুমন। নতুন করে সংসার পাতেন। এমন সময়ই সেরিব্রাল হয় তাঁর। এখানেই খেলা ঘুরে যায়। ভাগ্যের পরিহাসে মুখোমুখি হন সুমনের দুই অর্ধাঙ্গিনী। সংসার ছেড়ে এলেও শুভ্রা কিছু ভোলে না সংসারের। সেই সাহায্য করে সুমনের সমস্ত ডকুমেন্ট ইত্যাদি খুঁজে দিতে। সময়ের সঙ্গে গল্প এগোতে এগোতে ফের একটা নতুন বাঁক নেয়। আর সেখানেই নতুন করে সম্পর্কের আরও একটা দিক উঠে আসে। সেটা কি? সেটা জানতে গেলে ছবিটা দেখতেই হবে।
এখানে কৌশিক সেনের অংশ তুলনায় কম ছিল। গোটা গল্পই আবর্তিত হয়েছে চূর্ণী এবং জয়াকে ঘিরে। সঙ্গে ছিলেন অম্বরীশ ভট্টাচার্য। জয়া আর চূর্ণীকে নিয়ে সত্যি কথা বলার কিছু নেই। প্রতিটা এক্সপ্রেশন, সিন ভীষণই নিখুঁত করে ফুটিয়েছেন তাঁরা। একদিকে জয়া যেমন চূর্ণীর থেকে সাহায্য চাইছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন তেমনই ভুল ধরা পড়লে বদলে যেতে পিছপা হচ্ছেন না। অন্যদিকে সম্পর্ক ছেড়ে এলেও নিজের সংসার অন্য কাউকে তুলে দিতে, গুছিয়ে দিতে যেমন সাহায্য করছেন চূর্ণী তেমনই তাঁকে কথ শোনাতে আবার ভালোবেসে কাছে টেনে নিতেও রেয়াত করছেন না। প্রতিটা চরিত্রকে নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অম্বরীশ ভট্টাচার্য বরাবরে মতোই সহজ, সাবলীল। শাশুড়ির চরিত্রে লিলি চক্রবর্তী সহ বাকিরা যথাযথ।
এই ছবিতে গানের ব্যবহার, বিশেষ করে লিরিক্সের ব্যবহার আপনাকে চমকাতে বাধ্য করবে। অনবদ্য। ক্যামেরার কাজ বলুন কিংবা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ১০ এ ১০!
তবে ওই সবসময়ের মতোই এবারেও এই ছবির ইউএসপি আমার কাছে হয়ে থাকল কৌশিকের স্ক্রিপ্ট! কিছু ডায়লগ মনে গেঁথে গেল, যেমন 'বংশ রক্ষার সামাজিক দায়, দায়িত্ব মেয়েদেরই।' কিংবা 'একজন অসুস্থ মানুষের দেশ, দল, সম্পর্ক কিছুই থাকে না।' এক সংসারে থেকে নিত্যদিনের অশান্তির থেকে বরং 'ভালো থাক মন্দ থাক, নিজের মতো করে বাঁচ' এখান থেকে বেরিয়ে, ইত্যাদি প্রভৃতি। অধিকার ছেড়ে এলেই যে ছেড়ে আসা হয় না। বরং পরিস্থিতি বুঝে আমরা ধীরে ধীরে সেই অধিকার অন্য কাউকে সঁপে দিই সেটা ভীষণ পরিপাটি করে তুলে ধরা হয়েছে।
বর্তমান সময়ের ভাঙা গড়া, অহরহ ডিভোর্স, তিক্ততা, হাত ছাড়া ধরার মধ্যে একটা সুন্দর পরিপাটি গল্প উপহার দিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।