প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটা শয়তানের বীজ। একটু সন্দেহের সার আর ঘৃণার জল পেলেই সেই শয়তান ছাড়া গাছ তড়তড়িয়ে বেড়ে উঠে মহীরুহ হয়ে পরিণত হয়। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে লেখা উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটক ‘ওথেলো’ সেই সত্যিকেই গল্পের মোড়কে তুলে ধরেছিল পাঠকদের কাছে। দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে শেক্সপিয়রের যে সমস্ত নাটক এখনও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক তাদের মধ্যে অন্যতম হল ‘ওথেলো’। আর এই নাটকেই বাংলার সমাজ জীবনের চিত্রপটে প্রাণ দিয়েছিলেন অর্ণ মুখোপাধ্যায়।
সালটা ২০১৬, থিয়েটারের মঞ্চে উইলিয়ম শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’র বাংলা নাট্যরূপ ‘অথৈ’ মঞ্চস্থ করল নটোধা। উদ্দাম প্রেম, না পাওয়ার যন্ত্রণা, কামনা, স্নেহ, সন্দেহ সবটা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল মঞ্চের রঙিন আলোয়, আর দারুণ ভাবে হইচই ফেলে দিল থিয়েটার প্রেমিদের মধ্যে। সাত বছর ধরে মঞ্চে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পর, আবারও নতুন রূপে ১৪ জুন অর্ণ মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও সোহিনী সরকারের হাত ধরে স্ক্রিনে জীবন্ত হয়ে উঠবে 'অথৈ', 'গোগো', 'দিয়া'। না পাওয়ার যন্ত্রণা, প্রতিহিংসা, সাদা-কালোর ভেদাভেদ, মুখ আর মুখোশের খেলা নিয়ে 'অথৈ' মঞ্চে যে আলোরণ সৃষ্টি করেছিল, বড় পর্দাতেও কী বজায় রাখতে পারল সেই ম্যাজিক? অর্ণ মুখোপাধ্যায় কী প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারলেন তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবিতে?
আরও পড়ুন: ‘সাত বছর ধরে এই চরিত্রের আত্মা আমি নিজের মধ্যে বহন করছি’: ‘ অথৈ’ প্রসঙ্গে অর্ণ মুখোপাধ্যায়
কেমন হল অথৈ?
শহরের মতো বিলাসিতা দূরে থাক, নেই একটা ভালো হাসপাতালও। তাই একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে দিন গোনে ছোট্ট গ্রাম ভিনসুরা। আর ভিনসুরাকে স্বপ্ন দেখায় যে মানুষটা, সে এই সব প্রচেষ্টার কাণ্ডারি, সেই হল 'অথৈ'। তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া জন্যই গ্রামের মাঠে জমে ভিড়। কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন তাঁরই দেখা নেই। তবে 'অথৈ' গেল কোথায়? কোনও এক মায়ের মৃত্যু শয্যার পাশে, কারণ তার কাছে সবার উপর মানুষ সত্য। অপুষ্টির জন্য ছোট্ট বেলায় চোখের সামনে মায়ের মৃত্যুকে দেখেছিল সে। তাই জেদ চাপে গ্রামে হাসপাতাল আর নিজের ডাক্তার হওয়ার। ডাক্তার সে হয়, তবে হাসপাতাল? তার জন্য অথৈ-এর নিবেদিত প্রাণ।
আর ছোটবেলায় সেই মা হারা ক্ষুদ্র প্রাণে যে শক্তি জুগিয়ে ছিলেন তিনি হলেন অথৈ-এর জ্যাঠামশাই। না রক্তের সম্পর্ক নেই, শুধু মাত্র স্নেহের বাঁধন। তাই মায়ের মৃত্যুতে একলা হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে তিনি কেবল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানই নয়, দিয়েছিলেন শিক্ষাও। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, এই মন্ত্রও তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন অথৈ-এর মননে। কিন্তু তারই একমাত্র সন্তান 'গোগো' বারবার হেরেছে 'অথৈ'-এর কাছে। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও 'অথৈ'কে কখনও সে দৌড়ে পিছনে ফেলতে পারেনি। আর তাই সেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই ভিনসুরার ভগবান হয়ে ওঠা ছেলেটাকে শয়তান বানানোর দায়িত্ব নেয় সে।
'দিয়ামোনা' ওরফে মুনকে বিয়ে করে 'অথৈ'। গ্রামের বহু পুরুষের নজর তার উপর। কিন্তু 'অথৈ'-কে ভালোবেসে সে ছাড়ে নিজের বিলাসবহুল জীবনকে। জাতপাত, অর্থ-প্রতিপত্তির ঊর্ধে বাবার অমতে সে স্বীকৃতি দেয় ভালোবাসাকে। স্নেহ, ভালোবাসা আর বিশ্বাসই ছিল তার সংসারের শক্ত খুঁটি কিন্তু 'গোগো'-এর ষড়যন্ত্র ভেঙে চুরে শেষ হয়ে যায় সব। প্রিয় বন্ধুর মুখোশের আড়ালে গোগো একটু একটু করে অথৈ-এর কানে ভরে দেয় সন্দেহের বিষ। আর সেই বিষের জ্বালা জ্বালিয়ে দেয় সবকিছুকে। নিমেষেই ধ্বংস করে দেয় 'দিয়া'-এর সাজানো সংসার। তারপর? তার পরের গল্প নাটক-নভেল পড়ে সকলের জানা থাকলেও, অথৈ-এর ক্লাইম্যাক্সকে অর্ণ মুখোপাধ্যায় দিয়েছেন এক অসাধারণ রূপ। যা দেখে মুগ্ধতা আসতে বাধ্য।
কার অভিনয় কেমন লাগল?
অর্ণর পরিচালনা তো বটেই, 'অথৈ' হিসেবে নজর কাড়বে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ও। চোখের বদলাতে থাকা ভাষা, শরীরী ভঙ্গি, প্রতিমুহূর্তে চরিত্রটির বাড়তে থাকা অস্থিরতা আপনাকে অনুভব করাবে। অন্যদিকে, অনির্বাণ ভট্টাচার্য একেবারেই ভিন্ন রূপে, অন্য অবতারে মনজয় করে নেবেন। তাঁর চোখে-মুখে-ভঙ্গিতে ষড়যন্ত্রকারীর কুটিলতা ও চতুরতা দেখে রাগও যেমন হবে, আসবে মুগ্ধতাও। তাই এক কথায় বলাই যায় ইয়াগো ওরফে 'গোগো'র চরিত্রতে তিনি যথার্থ। পাশাপাশি কোমল অথচ কঠিন দিয়ার চরিত্রে সোহিনী সরকার বরাবরের মতই সাবলীল।
অন্যদিকে, বড়পর্দায় প্রথম কাজ হলেও, 'মুকুল'-এর চরিত্রে মুগ্ধ করবেন অর্পণ ঘোষালও। এরপরও যে অভিনেতা আরও ভালো ভালো চরিত্র উপহার দিতে চলেছেন তা ওঁর এই অভিনয়ই বলে দেয়। সঙ্গে মিলির চরিত্রে নজর কেড়েছেন মিমি দত্ত। তবে সব কিছুর মধ্যে দিতিপ্রিয়ার চরিত্রে চমক থাকলেও ভাটা পড়ল অভিনয়ে।
ওভারঅল কেমন লাগল?
ছবির গল্প থেকে চিত্রনাট্য সবটাই বেশ মনগ্রাহী। গম্ভীর চালের ছবি হলেও এতে রয়েছে প্রয়োজনীয় কমিক রিলিফ। তাছাড়া অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের অন্যান্য কাজগুলির মতো এই কাজও শুধু ইতিবাচক চরিত্র নয়, নেতিবাচক চরিত্রগুলির মনস্তত্ত্ব নিয়েও ভাবাবে। শুধু 'অথৈ'-এর নয়, কোথাও গিয়ে গোগোর খারাপ লাগাগুলোর সঙ্গে একাত্মবোধ করাবে। তাছাড়াও ক্যামেরার কাজ, আলো, ছবির কালার প্যালেট, ড্রিম সিক্যুয়েস এবং অনির্বাণের ফোর্থওয়াল ব্রেক অন্য মাত্রা দিয়েছে 'অথৈ'কে, কিন্তু কখনওই অতিরঞ্জিত করেনি। তবে নাটকের মঞ্চ থেকে বড়পর্দায় রূপান্তরে খানিক গতি খানিক মন্থর হয়েছে। আর একটু হয়তো ছোট করা যেত। তবে সবমিলিয়ে এক কথায় দারুণ এই ছবি মঞ্চের মতো বড় পর্দাতেও মন ছুঁয়ে যাবে।