বাংলাদেশে আগুন জ্বলছে, আর সেই আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে সেদেশের গৌরব, সেদেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস, আর কিছু মানুষ আর তাঁদের ভালোবাসার ঘরবাড়ি। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল, তবে সেই আগুনেই পুড়ে ছাই হয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। হাসিনাকে 'স্বৈরাচারী'র তকমা দিয়েছেন বেশিরভাগ বাংলাদেশী। আর তাই তাঁরা হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর স্বাধীনতা উদযাপনে উন্মত্ত। আর তাঁদের সেই উন্মাদনা ভেঙেছে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, মূর্তি। জেসিপি দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি, জাতির জনককে পরানো হয়েছে জুতোর মালা। শুরু হয়েছে সেদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্মম অত্যাচার।
নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই সব ভিডিয়োর সাক্ষী এখন গোটা বিশ্ব। আর এগুলি দেখে বহু মানুষের প্রশ্ন ‘এর নাম স্বাধীনতা?’ আর এবার বাংলাদেশের ছড়িয়ে পড়া সেই নানান ভিডিয়ো দেখে এই একই প্রশ্ন তুললেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।
নিজের ফেসবুকের পাতায় উন্মত্ত দেশবাসীর ধ্বংসলীলার নানান ছবি ও ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন তসলিমা। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রান্তে ভাস্কর্য ভাঙার ভিডিয়ো থেকে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের ছবি। আবার বহু সংখ্যালঘু মানুষ যে দেশছাড়তে প্রস্তুত, সেই ছবিও উঠে এসেছে লেখিকার পোস্টে। এবারও সবসময়ের মতো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন তসলিমা।
এখানেই শেষ নয়, বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি, হাসিনা সরকারের ঠিক-ভুল তুলে ধরেছেন প্রতিবাদী লেখিকা। ঠিক কী কারণে হাসিনা সরকারের পতন হল, কী কী ভুল করেছিলেন তিনি? তসলিমা সেগুলিকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। লিখেছেন,
'হাসিনা অবশ্যই কিছু উন্নয়ন করেছিলেন। অর্থনৈতিক উন্নতি করেছিলেন। সেতু আর মেট্রোরেল ইত্যাদি গড়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ২০ বছরের শাসনামলে কিছু ভুল তিনি তো অবশ্যই করেছিলেন।
১ দু দুবার ভোটারহীন নির্বাচন করেছিলেন। জনবিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন।
২ প্রধান বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন।
৩ একনায়কতন্ত্র আর স্বৈরাচারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।বাকস্বাধীনতাকে সহ্য করেননি।
৪ দলের লোকেরা, সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতি করা সত্ত্বেও তাঁদের বিচারের ব্যবস্থা করেননি।
৫ আগাগোড়াই মুসলিম মৌলবাদিদের প্রশ্রয় দিয়ে এসেছিলেন।
৬ প্রয়োজনের বাইরে মসজিদ মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন। মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমতুল্য করেছিলেন।
৭ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করেননি, বাহাত্তরের সংবিধান আনেননি।
৮ ছাত্র আন্দোলনের প্রথম দিনেই কোটা সংস্কার করা উচিত ছিল। এবং পুলিশকে ছাত্রদের গুলি করার অর্ডার দেওয়া উচিত হয়নি।
৯ পদত্যাগ করা উচিত ছিল আগেই। তাহলে দেশত্যাগ করার দরকার হতো না।
১০ চাটুকার বেষ্টিত ছিলেন। জনগণের অসন্তোষ আর ক্ষোভের খবর রাখেননি।
১১ জিহাদিরা যখন নাস্তিক ব্লগার হত্যা করছিল, তখন হুমকি পাওয়া ব্লগাররা নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করা সত্ত্বেও তিনি কাউকে নিরাপত্তা দেননি।
১২ নারীবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ওয়াজিদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন নতুন প্রজন্মকে মগজধোলাই করে জিহাদি বানাবার জন্য।'
শুধু তাই নয়, নতুন সরকার এলে তাঁদের ঠিক কী করা উচিত, সেটাও তুলে ধরেছেন তসলিমা নাসরিন। তিনি লিখেছেন,
'যারাই নতুন সরকার গঠন করুক, আশা করছি তাঁরা এই কাজগুলো করবেন।
১। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবের বাড়ির মিউজিয়ামটি অবিকল পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
২। শিল্পী রাহুল আনন্দর বাড়ি অবিকল আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
৩। সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। আর কেউ যেন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য না হয়। ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপুরণ দিতে হবে। মন্দির এবং মূর্তি গড়ে দিতে হবে।
৪। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাকস্বাধীনতা যেন বহাল থাকে।
৫। নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাদ দেওয়া চলবে না। নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলই অংশ নেবে।
৬। শেখ হাসিনা মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমতুল্য করে ভুল করেছিলেন। সমতুল্য করাটি যেন বাতিল করা হয়।
৭। নারীবিদ্বেষী এবং হিন্দু বিদ্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ীদের ওয়াজ যেন বন্ধ করা হয়। মনে রাখতে হবে মগজধোলাই এর মাধ্যমে জিহাদী সংখ্যা বাড়লে নতুন সরকারের সবাইকে আল্লাহু আকবার বলে একসময় কোপাবে এরা।
৮। নাস্তিকদের ১০০ ভাগ নিরাপত্তা দিতে হবে। যে নাস্তিকেরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, তারা যেন দেশে ফিরে আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
৯। মাদ্রাসাগুলোকে সাধারণ ইস্কুলে পরিণত করতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষায় ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষিত করতে হবে।
১০। নির্বাচনে প্রতিটি দল যেন ৫০% নারীকে নমিনেশান দেয়।
১১। সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে নারীর জন্য কোটা থাকবে ২০%,
১২। শেখ হাসিনা আর শেখ মুজিব এক নয়। শেখ মুজিবের ভাল কিছু মূর্তি, বীর শ্রেষ্ঠদের ভাষ্কর্য পূননির্মান করতে হবে।
১৩। আওয়ামী লীগ করা কোনও অন্যায় নয়। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীকে হত্যা করা, তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। অচিরে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।
১৪। ময়মনসিংহের শশীলজে ১২০ বছরের পুরোনো ভেনাস মূর্তি ফের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১৫। জয়নুল আবেদিনের মূর্তি নতুন করে গড়ে দিতে হবে।
১৬। সুনামগঞ্জের জাদুঘর ফের নির্মাণ করতে হবে। এবং আর যেসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে, সব গড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭। ধ্বংসযজ্ঞে যারা অংশ নিয়েছে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৮। যদিও নতুন নেতা মহম্মদ ইউনুস, আসিফ ইকবাল, সলিমুল্লাহ খান, পিনাকি ভট্টরা ভারত বিদ্বেষী, দেশের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।'
প্রসঙ্গত, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেন, সেদেশ কোন পথে চালিত হয় এখন সেটাই দেখার অপেক্ষায় রয়েছে গোটা বিশ্বের মানুষ।