‘ভাবতেও পারিনি, আমি বলে উঠব, আরও একটু বস, আরও একটু অপেক্ষা কর….’, না ফেরার দেশে বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সম্পাদক রঞ্জিত সিংহ। বাংলা কবিতা চর্চাকারীদের একটা বৃহৎ অংশের তিনি অচেনা. সেই অভিমান নিয়েই হয়ত অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন কবি। গত ৩০শে অক্টোবর ৩৬ বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতেই পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর চোট পান, শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন আইসিইউ-তে। ছিল বার্ধক্যজনিত নানান সমস্যাও।
শেষ রক্ষা হল না। সোমবার সকালে ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন ‘সমুদ্রশর্বরী’র কবি। তিনি যা দিয়েছেন, পরিবর্তে ফেরত পেয়েছেন সামান্য, সেই আক্ষেপই মৃত্যুর পর শোনা গেল তাঁর গুণমুগ্ধদের মুখে। যদিও কবির ভাবনা ছিল, ‘মানুষ কবিতা পড়ুক, কবি নয়’।
১৯৩৪ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন রঞ্জিত সিংহ। তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরুট কলকাতার তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে, পরবর্তীতে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে (এখনকার মৌলনা আজাদ কলেজ) থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। পেশায় বিজ্ঞাপন জগৎ-এর মানুষ ছিলেন। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর অগাধ টান ছিল। সেই কারণেই তাঁর কলম থামেনি।
যৌবনে পূর্বমেঘ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রঞ্জিত সিংহ। পরবর্তীতে বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম কবিতা সংকলন ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ যৌথভাবে সম্পদনা করেন মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে। ‘পরমা’ পত্রিকা ও প্রকাশনের সঙ্গেও নীবিড়ভাবে জড়িয়েছিলেন প্রয়াত কবি। প্রথম থেকেই কবি তাঁর লেখনিতে গভীর নির্জন এক পথের সন্ধান করেছেন। টি এস এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করেছেন, প্রবন্ধ, আত্মস্মৃতি লিখনেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
তাঁর প্রয়াণে গভীর শোকপ্রকাশ করেন সুবোধ সরকার। ফেসবুকে দীর্ঘ পোস্টে অগ্রজকে স্মরণ করে দীর্ঘ পোস্ট লিখেছেন তিনি। সুবোধবাবু লেখেন-
'বাংলা কবিতায় যদি কোনও নিভৃত সাধক থেকে থাকে তার নাম রঞ্জিত সিংহ। ছোটবেলায় বাংলা কবিতার একটি ত্রিভুজ ছিল আমার অবচেতনে। রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরি, মণীন্দ্র গুপ্ত এবং রঞ্জিত সিংহ। রঞ্জিতবাবু থাকতেন বালিগঞ্জ প্লেসে অথচ মনে হত তিনি বিরহী নামে কোনও গ্রহের নাগরিক। তাঁকে কোনদিন কোনও কবি সম্মেলনে দেখেনি কেউ। এতটাই অভিজাত ছিল তাঁর ব্যবহার কেউ তাঁকে কবিতা পড়তে ডাকেনি। তাঁর কোনও শত্রু ছিল না, তাঁর কোনও বন্ধু ছিল না। একজন ছাড়া। আমি কৃষ্ণনগর থেকে শিয়ালদহে নেমে ট্রামে উঠে বালিগঞ্জ নামলাম। আমার হাতে পায়ে তখন চর্যাপদের ঘাস। বহূ কষ্টে তাঁর বাড়ি পৌঁছলাম। তিনি আমাকে অনেক উৎসাহ দিলেন। খেতে দিলেন বড় বড় এক প্লেট মিষ্টি। আমি সবকটি খেয়ে ফেললাম। আমার গন্তব্য মণীন্দ্র গুপ্ত। তিনি আমাকে হিন্দুস্থান পার্কের তিনতলার গুহায় পৌঁছে দিলেন। তিনি পৌঁছে না দিলে আমি কোনদিন গড়িয়াহাট পেরিয়ে মণীন্দ্রবাবুর কাছে পৌঁছতে পারতাম না।
রঞ্জিত সিংহ মণীন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে একটি মারাত্মক কাজে হাত দিয়েছিলেন। প্রতি বছর বিরাট স্তুপ থেকে বাছাই করে 'এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা' বের করতে লাগলেন। এ রকম বার্ষিকী আমি ইওরোপ আমেরিকায় দেখেছি। এখানে হয় না। ওঁরা দুজন পেরেছিলেন কেননা ওঁরা কোথাও যেতেন না। গুহা থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে কলকাতার বৃষ্টি দেখতেন। এই অসামান্য বার্ষিকী সম্পাদনা করতে গিয়েই তাঁদের হাতে গরম তেল এসে পড়ে ।ব ন্ধ হয়ে যায় এ রকম একটা কাজ। বন্ধ করে দেওয়া হয়। কফি হাউসের নীচে সেদিন কবিরা সমবেত হয়ে মিছিল করে খালাসীটোলায় গিয়েছিলেন। যে সব কবির লেখা ছাপা হয়নি তাঁদের মিছিল।রঞ্জিত সিংহ এমন একজন কবি যিনি ভবিষ্যত পাঠকের জন্য রেখে গেলেন এমন সব কবিতা যা 'ডিকোড' করতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেগে যাবে। আজ যখন কবি সুধীর দত্ত ফোন করে আমাকে জানালেন নার্সিংহোমে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন, পোস্ট মর্টেম হবে, আমি অবাক হলাম। কবিতার জগতে তিনি কোনদিন কোথাও পড়ে যাননি, কেউ এসে তাঁকে তুলে দাঁড় করাননি। তাঁকে আমার প্রণাম।'
কবিতা রচনার স্বীকৃতি হিসেবে রঞ্জিত সিংহ পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি প্রদত্ত বিভা চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার-সহ একাধিক সম্মাননা। তাঁর মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হল বাংলা সাহিত্যে।