বাংলায় কি এখন বাঙালির অস্তিত্ব সংকট? বাংলাতে ক্রমেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে বাংলাভাষীরা? বাস-ট্রেন হোক কিংবা সিনেমাহল সর্বত্র সেই ছবি? জনৈকের পোস্ট শেয়ার করে এই ‘তোঁতো’ সত্যি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বরাবরই স্পষ্টবক্তা সুদীপ্তা। আরজি কর আবহে প্রকাশ্যে ময়দানে নেমে সওয়াল করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এদিন বাঙালির অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্ন ফের উস্কে দিলেন জাতীয় পুরস্কার জয়ী অভিনেত্রী। পুজোয় মুক্তি পাওয়া দুই বাংলা ছবির শো সংখ্যা হুড়হুমুড়িয়ে কমেছে ভুলভুলাইয়া ৩ এবং সিংঘম এগেনকে জায়গা করে দিতে। সেই নিয়ে টলিউডে উপচে পড়ছে ক্ষোভ।
টেক্কা এবং বহুরূপীর বাঁধভাঙা সাফল্যের পরেও কেন হলে জায়গা নেই বাংলা ছবির? এই আবহেই সুদীপ্তা এক জনৈকের পোস্ট শেয়ার করলেন।
অপর্ণ গুপ্ত তাঁর ফেসবুকের দেওয়ালে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তিনি লেখেন, 'গত সপ্তাহে আমার পিসি বাসে করে যাওয়ার সময়ে এক অবাঙালি ভদ্রলোককে বাংলায় সরে দাঁড়াতে বলেন। তিনি উত্তর তো ভদ্রভাবে দেনই নি, উলটে বলে দেন যে বাংলায় যেন কথা না বলা হয়। প্রতিবাদ করলে তাঁর বক্তব্য-'বঙ্গাল মে, আপলোগ সিক্সটি ফর্টি হো গ্যায়ে হো; হিন্দী মে হি বাত করনা হোগা।' চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যখন একথা তিনি বলছেন, তখন বাসের কেউ প্রতিবাদ করেননি, কারণ তিনি ভুল বলছেন না। বাসে বসে থাকা প্যাসেঞ্জারের ৬০ ভাগ-ই বিহার নতুবা উত্তরপ্রেদেশের লোক। লোকাল ট্রেনের টিকিট কাউন্টারে বাংলায় রাণাঘাট যাবার টিকিট দিতে বলা হলে অবাঙালি রেলকর্মী জানান যে তাড়াহুড়োর সময়ে যেন কেউ বাংলা না বলে, তাতে তাঁর কাজে সমস্যা হয়। আমার পরিচিত প্রতিবাদ করলে, তাঁকেই উলটে দাবিয়ে দেয় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি লোকেরা, কারণ সেই লাইনেও ৬০ শতাংশ অবাঙালি।'
পুজোর সফল বাংলা ছবির হলে জায়গা না পাওয়া নিয়ে তিনি লেখেন,'পুজোয় রিলিজ করা বাংলা ছবি, রমরমিয়ে ব্যবসা করেছে। কিন্তু হিন্দী ছবি আসা মাত্রই হল কমিয়ে হিন্দী ছবিকে দেওয়া হল, কারণ? বাংলার মাটি থেকে সালার, স্ত্রী-র মতো ছবিগুলি যে টাকা তুলে নিয়ে গেছে এতদিনে বাংলা ছবি তার অর্ধেকও তুলতে পারেনি। এর কারণ বাংলায় বাঙালি নেই। বাংলা এখন বাঙালিদের বৃদ্ধাশ্রম, আর বিহারী-উত্তরপ্রদেশীয় গোঁড়াদের চারণভূমি। হিন্দীভাষী জনতার কাছে যাতে অপশন বাড়ে, তাই বাংলা ছবিতে কোপ। অর্থাৎ বাংলার মাটিতে বাঙালি এখন সংখ্যালঘু।'
‘বাংলায় গ্রোথ নেই, ডেভেলপমেন্ট নেই’ তাই বাধ্য হয়ে তরুণ বাঙালিরা জীবিকার খোঁজে আজ ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন মেট্রোসিটিতে সাফাইকর্মীর কাজও করছে গ্র্যাজুয়েট কিংবা পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ডিগ্রি নিয়েও! অপর্ণ লিখেছেন, 'এদেশের বিভিন্ন মেট্রোসিটিতে সর্বাধিক বাথরুম সাফাইয়ের কাজ করেন বাঙালিরা। সুইগি-জোমাটোর খাবার ডেলিভারির ক্ষেত্রেও অন্য রাজ্যে গেলে দেখবেন বাঙালিরা ডেলিভারি করছে বেশি সংখ্যায়। ব্যাঙ্গালোরের আইটি হাবগুলোতে গিয়ে দেখুন, গিজগিজ করছে বাঙালি। এরা বাই চয়েস নেই, কম্পালশানে আছে। বাধ্য হয়ে। দশ হাজার-বিশ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে,এদিকে নিজেদের বাড়িতে পড়ে আছে বুড়ো বাপ-মা। লিংকডিন খুলুন, নকরি খুলুন- স্কিলসেট পুট করে লোকেশান ফিল্টারে কলকাতা দিন, দেখবেন একটাও রেসাল্ট আসছে না। আসবেও না। প্রত্যেকদিন এখানকার ছেলেমেয়েরা বাইরে যাচ্ছে বাধ্য হয়ে। কলকাতা সস্তা, কেন সস্তা? কারণ গ্রোথ নেই। ডেভেলপমেন্ট নেই। সস্তায় লেবার পাওয়া যায়। যে স্টার্ট আপে আপনি কলকাতায় ১০ টাকা কামাবেন, একই কাজ করে বাইরে ২০ টাকা কামাবেন। সম্ভবত নীরদ চৌধুরীর লেখাতেই পড়েছিলাম যে, অর্থনৈতিক দৈন্য বাঙালিকে একদিন শিকড় থেকে আলাদা করে দেবে৷ গত পাঁচ-দশ বছরে একদম সেই জায়গায় এসে পৌঁছেছে পরিস্থিতি। পঞ্চাশোর্ধ বাবা-মা, মধ্য ত্রিশের লোকজন যাদের নাইন্টিজ নস্টালজিয়া আছে, আর কিছু এক্সেপশান বাদে আজকের টিনেজাররা কেউ বাঙালির শিকড়ের সঙ্গে কানেক্টেডই নেই আর। সরকারী বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোর অবস্থা তথৈবচ। দিল্লীবোর্ডের স্কুলে বাংলা বহুক্ষেত্রে থার্ড ল্যাঙ্গোয়েজ। এই ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে সবাই চাইছে বাইরে চলে যেতে। রাস্তাঘাটে সর্বত্র শুনবেন একটাই কথা- 'বাইরে তো যেতেই হবে, এখানে তো কিসুই নাই...'।
এই পোস্ট শেয়ার করে সুদীপ্তা লিখেছেন, ‘সত্য, সর্বৈব সত্য।’ পোস্টের শেষভাগে শাসক শিবিরকেও পরোক্ষে আক্রমণ শানানো হয়েছে। লেখা রয়েছে, 'আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটা জেনারেশন প্রায় সত্তরভাগ শিফট হয়ে যাবে হাইটেক সিটিগুলিতে। যাবেই। সেখানে তারা দিওয়ালি 'মানাবে', রঙ্গোলি 'চিপকাবে', ডিনার 'পাকাবে' আর অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অপেক্ষা করে বসে থাকবে, কবে ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি ঘরে ফিরবে তার। রাজ্যজুড়ে দাপিয়ে বেড়াবে বিহার-ইউপির সখত লউন্ডারা; আর পড়ে থাকবে বিশ্ববাংলার এত্ত বড় 'ব'- বাবাজি কা ঠুল্লু!'