আমি ইরফান ভাই বলে ডাকতাম। ইরফান ভাই আমার সিনিয়ার ছিলেন ন্যাশান্যাল স্কুল অফ ড্রামা-তে। ৮৭ সালে উনি পাস আউট। ওঁদের যখন কনভোকেশন হয় সেই বছর ছিল আমার ফার্স্ট ইয়ার। এন এস ডি-তে ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা খুবই লিমিটেড থাকে। এই যেমন আমাদের ব্যাচে ১৯জন ছিল। প্রতি বছর ওই ১৯/২০ জন মতো পাশ করে বেরোয়। এত অল্প স্টুডেন্ট বলেই সবাই সবাইকে মোটামুটি চেনে। একটা পরিবারের মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠে নিজেদের মধ্যে। সেই সম্পর্ক কিন্তু আজও অটুট। আমাদের এন এস ডি-র বন্ধুদের একটা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। সেখানে রেগুলার কথাবার্তা হয় সকলের মধ্যে, বিশেষ করে যাঁরা মুম্বইতে থাকেন তাঁরা ইরফান ভাইয়ের সঙ্গে বেশি টাচে ছিলেন। সেখানে সাত দিন আগেও শুনলাম ইরফান ভাই এখন অনেকটা ভালো আছেন। অভিনেতা জাকির হুসেনও কিছুদিন আগে ববললেন, এখন আগের চেয়ে ভালো আছেন, সাবধানে আছেন। আংরেজী মিডিয়ামের শুটিং করলাম, সব ঠিকঠাকই আছে, শুনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। যখন থেকে ইরফান ভাই অসুস্থ তখন থেকে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে কমই আসতেন। কিন্তু যোগাযোগ ছিল সকলের সঙ্গেই। আমার বারবার মনে হত ভাইকে ফোন করে খোঁজ নিই কেমন আছেন, কিন্তু অসুখের কথা ওই ভাবে তো জিজ্ঞেস করা যায় না, তাই জাকিরের কাছে বা অন্য বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিতাম। আজ সকালে খবরটা পাওয়ার পর থেকেই নিজেকে শান্ত করতে পারছি না। ভাবতেই পারছিনা যে মানুষটা আর নেই!
বড্ড মনে পড়ছে এন এস ডি-র দিন গুলো। ইরফান ভাই আমার সিনিয়ার, আদিল হুসেন আর জাকির হুসেন আমার ব্যাচ মেট। নাওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকি আমার জুনিয়ার। আমদের ইচ্ছে ছিল সবাই মিলে এক সঙ্গে একই প্রজেক্টে কাজ করব। সেটা হবে আমাদের ড্রিম প্রোজেক্ট। এঁদের স্কুলিং এক। স্ক্রিন প্রেজেন্সও অসাধারণ। কিন্তু সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেল। দাদাভাই (আদিল হুসেনকে আমি দাদাভাই বলে ডাকি) ইরফান ভাই, জাকির, ওঁদের একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। লাইফ অফ পাইতে ইরফান ভাই বড়বেলার পাইয়ের চরিত্রে এবং আদিল হুসেন পাইয়ের বাবার চরিত্রে অসামান্য কাজ করেছেন। আর কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব! প্রত্যেকটা চরিত্রই তো একেকটা চ্যালেঞ্জ।
ন্যশনাল স্কুল অফ ড্রামার সেই ইরফান খানের বলিউড জয় করার লড়াইটা কিন্তু কোনও সিনেমার চেয়ে কম ইন্টারেস্টিং ছিল না। সেই ৮০দশক থেকে, ২০০৩ সালের ‘মকবুল’, একটা লম্বা লড়াই। এই সময়টাতে একবারের জন্যেও ধৈর্য্য হারাননি। একটা অত্যন্ত সাধারণ চেহারা নিয়ে, কোনও রকম এক্স ফ্যাক্টর ছাড়া শুধুমাত্র অভিনয়ের জোড়ে বলিউডে রাজ করে গেলেন ইরফান ভাই। মুম্বইতে,বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও রকম ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া, স্টার হয়ে ওঠা মানে অসাধ্য সাধন করা। আর সেটাই তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। অভিনয়ের জোড়ে আম দর্শকের সব রকম ধ্যান ধারণা বদলে দিয়েছিলেন তিনি। সাধারণ দর্শকের কাছে হিরোর যে কনসেপ্ট ছিল, ইরফান ভাই তা বদলে দেন। মানুষ সাধারণ লুকের মধ্যেই তাঁদের নায়ককে দেখতে অভ্যস্থ হতে শুরু করেন।
ভারত এক খোঁজ- এর সময় আমি স্কুলে পড়ি, টিভিতে দেখতাম, ইরফান খান তাতে অভিনয় করতেন। তারপর আবার দেখা ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-তে এসে। ওঁদের ব্যাচের সকলেই এখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য। মিতা বশিষ্ট, অনুপ সোনি, সুতপা শিকদার (ইরফান ভাইয়ের স্ত্রী), আর আদিল হুসেন, নাওয়াজ উদ্দিন, জাকিরদের কথা তো আগেই বললাম। সবাই মিলে একটা পরিবার। আসলে ইরফান ভাই ট্র্যাভেলটা করেছেন। ওঁর যখন জার্নির স্ট্রাগ্যলটা শুরু হয় সেই সময় খুব কাছের থেকে দেখেছি ওঁকে। তখন সামান্য একটু কাজ পাওয়ার জন্যও অনেকটা লড়াই করেছেন। এমনও হয়েছে ওই কম বয়েসে বয়স্ক বাবার চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। নিজের জায়গাটা পাকা করতে অনেক লড়াই লড়েছেন, তারপর কিন্তু মকবুল। সিনেমা জগতের একটা বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল, যা কোনও দিনই পূরণ হবে না। আমার মনে হয়, অসুস্থ তো ছিলেনই, তার ওপর এই যে একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি সেটা কিন্তু আমাদের সকলের মনেই একটা নেগিটিভ প্রভাব ফেলছে, হয়ত ইরফান ভাইয়ের মধ্যেও সেই প্রভাব পড়েছিল! তার মধ্যেই মায়ের মৃত্যুটা ওঁকে ভেতর থেকে বড্ড নাড়া দিয়েছিল। সব কিছু মিলিয়েই বোধহয় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না।