ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টের উপর রাশ টানতে আগেই ব্যবস্থা নিয়েছে মোদী সরকার, এবার সিনেমাটোগ্রাফ আইনে সংশোধন করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে কেন্দ্র। পরিচালকদের বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করবে কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ অভিযোগ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় অংশের, যা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দানা বাঁধছে।
মোদী সরকার সিনেমাটোগ্রাফ (সংশোধনী) বিল, ২০২১-এর খসড়া প্রকাশ করেছে ইতিমধ্যেই, যা দেখে চমকে উঠেছেন পরিচালক, প্রযোজক থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। এই সংশোধিত আইন বলে কেন্দ্রের হাতে কার্যত ‘সুপার পাওয়ার’ থাকবে যে কোনও ছবির প্রদর্শন ও সেন্সরের মামলায়। খসড়া বলছে এই আইনানুসারে কেন্দ্র সরকারের কাছে ক্ষমতা থাকবে ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ডের প্রধানকে কোনও ছবির সার্টিফিকেশন পুর্নবিবেচনা করতে বলবার। সুতরাং মুক্তি পাওয়া কোনও ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে তা সেন্সর বোর্ডের কাছে পাঠাতে পারে। পাশাপাশি দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্ব, দেশের সুরক্ষ, প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে যে কোনও ছবির প্রদর্শন আটকে দিতে পারবে কেন্দ্র।
এই আইনের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিমধ্যেই অনুরাগ কশ্যপ, শাবানা আজমি, ফারহান আখতার, জোয়া আখতারসহ দেশের ১৪০০ জন ফিল্মমেকার কেন্দ্রকে খোলা চিঠি লিখে নিজেদের আশঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছে। গোটা বিষয় নিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল পরিচালক শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে। গোটা বিষয় নিয়ে নিজের সহকর্মীদের সঙ্গে সহমত হওয়া তো দূর অস্ত বরং উলটো মত পোষণ করলেন শ্যাম বেনেগাল। ফিল্ম সার্টিফিকেশনের বৈধতা বিচারে তৈরি এক কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন শ্যাম বেনেগাল। হিন্দুস্তান টাইমসের সাংবাদিক সুনেত্রা চৌধুরীকে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এটা (এই খসড়া) একদম ঠিক আছে, কোনও সমস্যা নেই। দুটো রিপোর্ট ছিল, একটা মুদগল কমিটির রিপোর্ট (২০১৩) এবং অন্যটা আমাদের কমিটির, যা ২০১৬ সালে তৈরি হয়েছিল… দুটোর মধ্যে বিশেষ কোনও ফারাক নেই… উল্টে আমাদের সহযোগিতা করা উচিত…’।
সিবিএফসি-র কাছ থেকে ছাড়পত্র পাওয়া বা মুক্তি পাওয়া ছবিকেও আটকে দিতে পারে সরকার, এই বিষয়টা নিয়ে ‘অঙ্কুর’ পরিচালকের কী ভাবনা? তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো থাকতে পারে, যদি কোনও ফিল্মকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয় সেটা আজীবন বহাল থাকবে এমন কোনও কথা নেই। যখন আপনি পরিবর্তনের কথা বলছেন, মাথায় রাখতে হবে গোটা দুনিয়াটাই বদলাচ্ছে। অতীতে যা গ্রহণযোগ্য ছিল, আজ সেটা নাও হতে পারে।
তাই কোনও ছবিকে আবারও রিভিউ করা হলে তার মধ্যে অনুচিত কিছু নেই।এখন তো সার্টিফিকেট দেওয়া হলে তবেই ছবি জনসমক্ষে প্রদর্শিত করা হয়, কিন্তু সেই সার্টিফিকেটের কোনও সময়সীমা থাকে না। হতেই তো পারে আজ যা দর্শককে দেখানো যাচ্ছে, ২০ বছর পর সেই ছবি জনসমক্ষে প্রদর্শন করা সঠিক হবে না। সেটা হতেই পারে!' উদাহরণ টেনে শ্যাম বেনেগাল জানান, শোলে ছবিতে ধর্মেন্দ্রর বেশ কিছু সংলাপ আজকের দিনে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করতে পারে সেটা ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘তাণ্ডব’সহ একাধিক ওটিটি কনটেন্টের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানার অভিযোগ উঠেছে। জনগণের সেই ক্ষোভ তো সার্টিফিকেট পাওয়ার পরেও ঘটতে পারে, সেই ক্ষেত্রে গোটা বিষয়টা কেমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে? শ্যাম বেনেগালের কথায়, ‘যদি আপনি কোনও তাণ্ডবলীলার মধ্যে পড়েন, এবং সেটা বাড়তেই থাকে তখন তো বিষয়টা নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হবে সরকার’। কখন সেই বিক্ষোভ লাগাম ছাড়িয়েছে সেটা কে নির্ধারণ করবে? এই প্রশ্নের জবাবে ‘কমন সেন্স’কে কাজে লাগানোর কথা বলেন বর্ষীয়ান পরিচালক। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সিরিজ বা ছবিতে যে ধরণের ভাষার প্রয়োগ হয় তা জনসমক্ষে বরবার যোগ্য নয়, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না বলেই মনে করেন শ্যাম বেনেগাল। সেইজন্যই ছবি যেহেতু বাড়িতে নয়, পাবলিক প্লেসে প্রদর্শিত হয় তাই সকলকে সেই ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে বলে জানান তিনি।
এই মামলায় ফিল্মমেকারদের নিজেদের সংবেদনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে বলে মনে করেন শ্যাম বেনেগাল, তাঁর কথায়, সংবেদনশীলতা যতক্ষণ না পর্যন্ত জনসমক্ষে আপত্তিজনক হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ সেটা আপত্তিজনক নয়।
১৪০০ ফিল্মমেকার যে খোলা চিঠি লিখে সিনেমাটোগ্রাফ আইনে সংশোধনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে চিন্তা জাহির করেছেন, তাঁদের সঙ্গে এক্কেবারেই সহমত নন শ্যাম বেনেগাল। উলটে তিনি বলেন, ‘তোমার ঘরে কী ঘটেছে তা গোটা দুনিয়ার লোকের জানবার দরকার নেই, সেটা ছবিতে তুলে ধরবারও দরকার নেই। প্রকাশ্যে কী দেখানো যায়, তা বোঝবার এবং উপলব্ধি করবার দরকার আছে। যদি তুমি কোনও গল্প বল, সেটা পারিবারিক গল্পও হয় তখনও সেই পারিবারিক গল্পে কোনটা প্রাইভেট আর কোনটা পাবলিক সেটা আলাদা করে নিতে হয় পরিচালককে। অনেক কিছু ফ্যাক্টর এর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে’।