নাইন্টিজ-এর হিন্দি ছবির গান, আজও অনেক সংগীতপ্রেমীর কাছে সেটা মিউজিকের স্বর্নযুগ। আর সেই স্বর্ণযুগে স্বর্ণিম অক্ষরে নাম লেখা আছে যে সকল মিউজিক ডিরেক্টরের তার মধ্যে অন্যতম শ্রবণ রাঠোর। যদিও একক শিল্পী হিসাবে নয়, সংগীত পরিচালক জুটি নদিম-শ্রাবণ হিসাবেই তিনি সমাধিক পরিচিত। দিন কয়েক ধরেই করোনা আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিলেন শ্রবণ রাঠোর। বৃহস্পতিবার রাতে সে লড়াই থেমে গেল। চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন ৬৭ বছর বয়সী এই শিল্পী।
নদিম-শ্রবণ জুটির পথচলা শুরু সত্তরের দশকে। তরুণ তরতাজা দুই সংগীতের ছাত্র কাজ শুরু করেছিল ভোজপুরী ছবিতে। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় 'দঙ্গল', যেখানে নদিম-শ্রবণের সুরে গান গেয়েছিলেন মান্না দে-র মতো শিল্পী। হিন্দি ছবিতে এই জুটির সফর শুরু করেছিল ১৯৮১ সালে। ‘মেয়নে জিনা শিখলিয়া’ ছবির সঙ্গে শুরু হয়েছিল নদিম-শ্রবণের বলিউড জার্নি। তবে সেই অর্থে সাফল্য পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দীর্ঘ ৯ বছর।
১৯৯০ সালে মুক্তি পেল ‘আশিকী’। হিন্দি মিউজিকের দুনিয়ায় মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল এই ছবি। কুমার শানুর কন্ঠে ‘বস এক সনম চাহিয়ে আশিকীকে লিয়ে’ আজও ভুলতে পারিনি আমরা।
তখন ইউটিউবের জমানা নয়, জিও সাওয়ান কিংবা গানা ডট আসেনি। অডিও ক্যাসেটের সেই জমানায় আশিকীর ২ কোটি ক্যাসেট বিক্রি হয়েছিল-সেই রেকর্ড আজ পর্যন্ত কোনও ছবি ভাঙতে পারেনি।
সেই শুরু নদিম-শ্রবণ জুটির আকাশছোঁয়া সাফল্য, এরপর একের পর এক নতুন মাইলস্টোন। ‘সাজান’, ‘দিল হ্যায় কে মানতা নেহি’, ‘সড়ক’, 'দিলওয়ালে','রাজা হিন্দুস্তানী', ‘ফুল অউর কাঁটে’-র মতো অজস্র হিট ছবির সুপারহিট মিউজিক অ্যালবামের দায়িত্বভার সামলেছেন তাঁরা।
সব জঁর গান কম্পোজ করেছেন নদিম-শ্রবণ। তবুও গানের মনছোঁয়া মেলোডি-র জন্যই সবচেয়ে বেশি সমাদৃত তাঁরা। গজল এবং ধ্রুপদী ঘরনার সংগীতের ব্যাপক প্রভাব তাঁদের কম্পোজিশনে লক্ষ্যণীয়। সমীর, আনন্দ বক্সী, ফয়জ আনওয়ারের মতো গীতিকারদের সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা। একাধিক সংগীত শিল্পীর সঙ্গে কাজ করলেও নদিম-শ্রবণ জুটির কম্পোজিশনে বেশিরভাগ ছবির গানে গলা মিলিয়েছেন কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক এবং উদিত নারায়ণ।
সাফল্যের মাঝেও আচমকাই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে এই জুটির নাম। টি-সিরিজের কর্ণধার গুলশন কুমারের হত্যার (১৯৯৭) চক্রান্তে জড়িত থাকার মামলায় নাম জড়ায় নদিম সইফির। এরপর দেশ ছেড়ে লন্ডনে পালিয়ে যান নদিম। স্বভাতই এই জুটির মিউজিক্যাল কেরিয়ারে চলে আসে সাময়িক বিরতি। যদিও গুলশন হত্যা মামলায় কোনওভাবেই নাম উঠে আসেনি শ্রবণ রাঠোরের। নদিম সইফির বিরুদ্ধেও অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয় পুলিশ।
নতুন শতাব্দীতে ‘ধড়কন’ ‘ইয়ে দিল আশিয়ানা’, ‘এক রিসতা’, ‘কসুর’, ‘হাম হো গায়ে আপকে’,'রাজ', ‘দিল হ্যায় তুমারা’, ‘কায়ামাত’, ‘হাঙ্গামা’, ‘আন্দাজ’, ‘বেবফা’-র মতো ছবির গান কম্পোজ করেছেন নদিম-শ্রবণ। লন্ডনে থেকেই কাজ করে গিয়েছেন নদিম, অন্যদিকে মুম্বইতে থেকেই বন্ধুর সঙ্গে মিলে মিউজিক্যাল সফর জারি রেখেছিলেন শ্রবণ। ২০০৫ সালে 'দোস্তি : ফ্রেন্ডস ফরএভার' ছবি পর ভেঙে যায় এই জুটি। চার বছরের বিরতির পর ‘ডু নট ডিসটার্ব’ ছবিতে আবারও একসঙ্গে কাজ করেছিলেন তাঁরা।
শুধু দর্শক নয়, পুরস্কার মঞ্চেও সমাদৃত নদিম-শ্রবণের সংগীত। চারবার ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে সেরা সংগীত পরিচালকের পুরস্কার জিতেছে এই জুটি। করোনা পূর্ববতী সময়ে নতুন করে এই জুটির কামব্যাকের খবর শোনা যাচ্ছিল, তবে সেই সফরে অবশেষে চিরকালের মতো পূর্ণচ্ছেদ পড়ল। আজীবনের মতো চার দশকের বন্ধু নদিমের হাত ছাড়িয়ে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন শ্রবণ রাঠোর। রেখে গেলেন তাঁর দুই পুত্র সঞ্জীব ও দর্শন রাঠোরকে।