বুধবার সকালে প্রয়াত হয়েছেন কিংবদন্তি বলি-অভিনেতা দিলীপ কুমার।দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। এদিন সকালে মুম্বইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। অভিনেতার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ বলিউড। শোকের আঁচ এসে পৌঁছেছে টলিপাড়াতেও। ১৯৭০ সালে মুক্তি পেয়েছিল তপন সিনহা পরিচালিত ছবি 'সাগিনা মাহাতো'। সেই ছবিতে মুখ্যভূমিকায় দিলীপ কুমার, সায়রা বানু ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায় এবং রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। হিন্দুস্তান টাইমস-কে ফোনের ওপর থেকে তাঁর 'ইউসুফ ভাই'-এর উদ্দেশে শোকজ্ঞাপন করে 'সাগিনা মাহাতো'-র শুটিং চলাকালীন দিলীপকুমারের সঙ্গে নিজের অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন বাংলা নাটকের এই কিংবদন্তি অভিনেতা।
দিলীপকুমারের ব্যাপারে কথা উঠতেই প্রথমে সামান্য থেমে বললেন,'বহুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তবু ওঁর চলে যাওয়াটা...জানি না কী বলব, কী বলা উচিৎ। ইউসুফ ভাই-এর মৃত্যুর খবরটা শুনে এত স্মৃতি ভিড় করে আসছে।' জানা গেল, প্রয়াত বলি-তারকাকে 'ইউসুফ ভাই' বলেই ডাকতেন রুদ্রপ্রসাদবাবু। দিলীপ কুমার নিজেই সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন যাতে ওঁকে সহ-অভিনেতারা 'স্যার' বলে না সম্বোধন করেন। শুধু 'ইউসুফ ভাই'। ব্যাস! আরও জানা গেল, দার্জিলিংয়ে তখনও শুটিং শুরু হয়নি। কালিম্পংয়ে পালচৌধুরীদের বাংলোয় দিলীপ কুমার, সায়রা বানু সহ গোটা শুটিং ইউনিট উঠেছেন। বলা নেই,কওয়া নেই শুরু হল বৃষ্টি। ঝোড়ো হাওয়া সহ সেই বৃষ্টি চলেছিল টানা চারদিন। শুটিং ততদিনে মাথায় উঠেছে। সেসময় বেশিরভাগ সময়টাই চলত নিখাদ আড্ডা মেরে, খুনসুটি করে। আর এই আড্ডার উদ্যোগ নিতেন 'দিলীপ সাব' স্বয়ং।
রুদ্রপ্রসাদের কথায় ,' সেই প্রথম ওঁকে সামনে থেকে দেখা। একটা গাম্ভীর্য্য ছিল বটে কিন্তু ইউসুফ ভাইয়ের অন্দরে যে ছোট একটি ছেলে লুকিয়ে থাকত এবং সময় পেলেই হইহই করে দুস্টুমি করত, তা টের পেয়েছিলাম ভালোভাবেই। একটা ঘটনা বললে বুঝবেন। অনিল মানে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের ভাইপো তখন আমাদের সঙ্গে সেই শুটিংয়ে এসেছিল। ছোট ছেলে। বয়স বেশি নয়। তা রোজ রাত্রে ও স্লিপিং স্যুট পরে ঘুমোতে যেত। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন ইউসুফ ভাই। একদিন সবার সামনে গলা হাঁকিয়ে বলে উঠলেন,' এই, এই রোজ ইউজ একইরকম বোরিং জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াস কেন রে?এক কাজ কর খুলে ফেল। চটপট খুলে ফেল!' অনিলের ভাইপো তখন পালাতে পারলে বাঁচে। ইউসুফের ভাইয়ের মুখের হাসি ততক্ষণে সঞ্চারিত হয়েছে আমাদের মুখেও। তাছাড়া আশেপাশের পাহাড়ি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় পেলেই গল্প-আড্ডা দিতেন। খুনসুটি করতেন। ওঁর মতো এত বড়ো একজন তারকার এহেন সাধারণ রূপ দেখে অবাক হয়েছিলাম। মুগ্ধ তো হয়েইছিলাম।'
গল্পের শেষ এখানেই নয়। কথা প্রসঙ্গে উঠল দিলীপ কুমারের বাংলার প্রতি ভালোবাসা নিয়ে। ' ওরে বাবা, দুর্দান্ত ভালো বাংলা বলতে পারতেন। 'দেবদাস' ছবির সময় যে বাংলাটা জবরদস্ত শিখেছিলেন সেটা বোঝা গেছিল। বাংলাতেই ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেন আমাদের সঙ্গে। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার বড্ড সাধ ছিল ওঁর।' জানালেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত।
বাদ গেল না 'ইউসুফ ভাই'-এর অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসার কথাও। আনমনেই বলে উঠলেন,' এত অসামান্য স্কিল ছিল অভিনয়ের..এত পরিশ্রম করতে পারতেন। বিশেষ করে ওই ডাবিংয়ের সময়। আমরা যেখানে ডাবিং চটপট শেষ হলে বাঁচি সেখানে উনি ডাবিংটা মনে করতেন অভিনয়ের শেষ এবং বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বলতে চাইছি, ডাবিং নিয়েই ওঁর কাছে অভিনয় ছিল পরিপূর্ণ একটি প্যাকেজ। অর্থাৎ গলা দিয়ে স্বরটাকে কীভাবে আরও নানাভাবে খেলানো যায় অবিরাম তা নিয়ে ভাবতেন। চেষ্টা করে যেতেন। নিজের চোখে দেখা এমনও হয়েছে একেকটি সংলাপ, একেকটি বাক্য কুড়িবার, পঁচিশবার করে ডাব করছেন। করেই যাচ্ছেন। যাকে বলে পারফেকশনিস্ট আর কী।
বক্তব্যের শেষে এই কিংবদন্তি মঞ্চ-অভিনেতার সংযোজন,' শেষবার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বছর পনেরো কিংবা কুড়ি আগে। মুম্বই গেছিলাম নাটকের শো করতে। কথা,হাসি ভাগ হয়েছিল। সেই শেষ। তারপর আর....এখন তো চলেই গেলেন।'