পুরীর সমুদ্র, এক শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর মা। মহিলার পরনে চওড়া পাড়ের সবুজ শাড়ি। আর ছোট্ট মেয়েটি পরেছে লাল জামা, তার মাথায় ফিঁতে দিয়ে ঝুঁটি বাঁধা। থুড়ি, শিশু কন্যা নয়, এটি শিশুপুত্র। যিনি কিনা বর্তমানে টলিপাড়ার একজন নামী পরিচালক, অভিনেতা। সেদিন তাঁকে মেয়ের মতো করেই সাজিয়েছিলেন তাঁর মা।
কি চিনতে পারছেন না তো?
চিনতে পারার কথাও নয়। ইনি হলে পরিচালক, অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়। সেদিনও তাঁকে শিশু পুত্র ভেবেই ভুল করেছিলেন সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাওয়া বহু লোকজন। কিন্তু কেন মেয়েদের মতো করে ছোট্ট ছেলেকে সাজিয়েছিলেন তথাগতর মা? কারণ, হিসাবে পরিচালক-অভিনেতা জানিয়েছেন, তাঁর মা চেয়েছিলেন দ্বিতীয় সন্তান যেন মেয়েই হয়, তবে হল ছেলে। তবে মেয়ের সাধ পূরণ করতেই ছোট্ট ছেলেকেই সেদিন মেয়ের মতো করে সাজিয়েছিলেন পরিচালকের মা। রবিবার ফেসবুকের পাতায় সেই ছোটবেলার ছবি ভাগ করে নিয়ে নিজের কিছু অনুভূতি শেয়ার করেছেন তথাগত।
পরিচালক লিখেছেন, ‘ভাগ্যিস মেয়ে হয়ে জন্মাইনি। ছোটবেলার ছবিটা পুরীর সমুদ্রের ধারের। আমার মা চেয়েছিল দ্বিতীয় সন্তান যেন মেয়েই হয়,হলাম আমি। ছোটবেলায় খুব লম্বা চুল ছিল। তাই অধিকাংশ সময় মা চুল ফিতে দিয়ে বেঁধে, এমন পোশাক পরিয়ে, টিপ পরিয়ে রাখত, যাতে কিছুক্ষনের জন্য হলেও পথচলতি লোকজন ভুল করে বলে ফেলে ভীষন মিষ্টি মেয়ে আপনার। ব্যাপারটার প্রমান অজস্র পুরোনো ছবিতে আমি পেয়েছি। বড় হওয়ার সাথে শরীরে ব্যাপারটা পালটে গেলেও মননে খানিকটা থেকেই গেল। সে কথা দিদি,বান্ধবী,প্রেমিকা,স্ত্রী এদের কাছে শুনেছি বহূবার, আমার কিছু আঁকড়ে ধরা- টরা কিম্বা ভাবা নাকি মেয়েদের মতোন। যেহেতু আমি মেয়ে নই তাই যাচাই করে উঠতে পারিনি মেয়েদের মতোন না হলে আর হলে ঠিক কীরকমটা হয়।’
তথাগতর লেখার প্রথম প্যারা পরেই হয়ত অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে, ‘ভাগ্যিস মেয়ে হয়ে জন্মাইনি।’ মন কথা কেন বলেছেন তিনি? তবে কি মেয়ে হওয়া অন্যায়?
নাহ পরিচালক কেন একথা বলেছেন, সেটি তাঁর লেখার পরের ধাপেই স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন, ‘ভাগ্যিস হইনি, নইলে আমাকে ভাবতে হত জয়নগরের মেয়েটা আমি হতে পারতাম, কিংবা রাজারহাটের বা আর জি করের মেয়েটা, কিংবা কামদুনি,মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি আসলে গোটা ভারতবর্ষের যে কোনও অঞ্চলের যে কোনও বয়সের মেয়ে। এমন এক প্রজাতির প্রতিনিধি হিসেবে বড় হতে হোতো যে কোনোদিন, যে কোনও বয়সে তার সাথে যে কোনও কিছু ঘটতে পারে ভারতবর্ষ নামক দেশের এই গনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়। এখানে দু বছরের মেয়ে শিশুও তো ছাড় পায় না। আমি তো বরং সেই সম্প্রদায়ের অংশ যারা এই দেশে যে কোনও সময় যা কিছু করে ফেলার ক্ষমতা রাখে।আমার মায়ের তো নিশ্চিন্ত আর খুশি হওয়ার কথা। অথচ আমার মা খুশি হতে পারেনি।কারন মা গল্প করার বন্ধু পায়নি, সমব্যথী পায়নি, অল্পবয়সের কষ্টের গল্প বোঝার লোক পায়নি, জড়িয়ে ধরে কাঁদার লোক পায়নি, যন্ত্রনা বোঝার সমমনস্ক সচেতন মন পায়নি, একই দুঃখ ভাগ করার মতো মানুষ পায়নি। শুধু পেয়েছে এই সমাজে আমার ধর্ষিত না হওয়ার নিশ্চিন্ততা। আমি কিন্তু নিশ্চিন্ত হয়েছি, মায়ের ইচ্ছে পূর্ন হয়নি। আমি ছেলে হয়েছি,পুরুষ....বাঙালি পুরুষ সিংহ।’
তথাগত আরও লেখেন, ‘আমি আফ্রিকাতে ছয় ফিটের ডিস্টেন্সে বহু সিংহ দেখেছি, ঘুমোতে আর হিসু করতে। পরে পড়াশুনা করে জানলাম শিকার করে খাবার জোগাড় করা, বাচ্চাদের বড় করা, দল গঠন করা এ সমস্ত তুচ্ছ কাজ সিংহীরাই করে। সিংহরা শিকার করে আনা খাবার খায়, ঘুমোয়,পটি করে আর সিজনে সেক্স করে। আমি টের পেলাম ভারতীয় বাঙালিদের কেন পুরুষ সিংহ বলা হয়। আমিও সেই পুরুষ সিংহ দলের প্রতিনিধি। ভাগ্যিস,মেয়ে হয়ে জন্মাইনি।’