আলোর উত্সবের মাঝেই বাঙালির মনে গভীর অন্ধকার। সকলকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর সে কোথা কবে’- এই প্রবাদবাক্যও স্মরণ করলেও মন মানছে না। আর কোনওদিন খিদ্দার গলায় শোনা যাবে না- ‘ফাইট কোনি ফাইট’। চিরকালের মতো নিভে গেল বাংলা তথা ভারতীয় ছবির অন্যতম উজ্ব্ল তারকা। বাংলা চলচ্চিত্রের একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। রবিবার, দুপুর ১২.১৫ মিনিটে কলকাতার বেলেভিউ হাসপাতালে প্রয়াত হলেন ৮৫ বছর বয়সী এই অভিনেতা।
সৌমিত্র মানেই বাংলা ছবির বেলাশেষ নয় বেলাশুরু। ছয় দশক ব্যপ্ত তাঁর ফিল্মি কেরিয়ার। বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। রোম্যান্টিক হিরো থেকে ভিলেন কিংবা ট্র্যাজিক নায়ক হয়ে উঠা- সব চরিত্রেই সিদ্ধহস্ত সৌমিত্র।
উত্তম সমসাময়িক যুগেও বাঙালির মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিলেন সৌমিত্র। ছয় দশক দীর্ঘ তাঁর চলচ্চিত্র জীবন। অভিনয় ছিল তাঁর জীবনের অক্সিজেন, বলতেন- ‘আমি অভিনয় করছি বলেই তো সুস্থ আছি’।
১৯৩৫ সালে কৃষ্ণনগরে জন্ম সৌমিত্রবাবুর। বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্টের উকিল ছিলেন। তবে নাটকের চর্চা নিয়মিত ছিল পরিবারে,বাবা নাটকের দলে অভিনয় করতেন। ছোট থেকেই সেই পরিবেশে বড় হওয়া তাঁর। তখন থেকেই অভিনয়ের প্রেমে পড়ে যান সৌমিত্র। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স(বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অভিনেতার রুপোলি সফর শুরু হয়, ১৯৫৯ সালে। ছবির নাম অপুর সংসার, যা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিত্ রায়।
ছয় দশক দীর্ঘ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কর্মজীবন। ২৫০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্রবাবু। শুধু সত্যজিত রায় নন, তপন সিনহা, মৃণাল সেন,তরুণ মজুমদার থেকে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়,অতনু ঘোষ, সুমন ঘোষের মতো আজকের প্রজন্মের পরিচালকদের ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
তবে সৌমিত্র তো শুধু চলচ্চিত্রাভিনেতা নয়, তিনি বাংলার সংস্কৃতির সবক্ষেত্রে নিজের অবদানের ছাপ রেখে গিয়েছিলেন। নাট্যশিল্পী হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দেশজোড়া কদর।তিনি শুধু নাটকে অভিনয় করেনি নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন। অভিনেতার কর্মজীবন শুরু আকাশবাণীর ঘোষক হিসেবে। তাঁর আবৃত্তি দশকের পর দশক ধরে মন ভরিয়েছে আপামর বাঙালির। কবিতা লেখার কাজ, পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অবসর সময়ে ছবি আঁকতেও ভালোবাসতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
২০০৪ সালে ভারত সরকারের তরফে পদ্মভূষণ সম্মান পান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ২০১১ ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এরপর ২০১৮ সালে প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় হিসাবে ফরাসি সরকারের সেরা নাগরিক সম্মান ‘লিজিয়ঁ দ’নর’ পান তিনি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও এতখানি সমাদৃত বাঙালির প্রাণের অপু।
'যা কিছু আমি, যা কিছু আমার সবই বাঙালির দেওয়া'- নিজের মুখে একথা বলে গিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যি তো বাঙালির সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক তিনি। বাঙালির মনের মণিকোঠায় আজীবন বিরাজমান থাকবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যা-কখনও অপু, কখনও ফেলুদা, কখনও কমরেড, কখনও ফাইটার, কখনও আবার একজন অভিভাবক হিসাবে।