উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটক ‘ওথেলো’ অবলম্বনে তৈরি ‘অথৈ’ ১৪ জুন মঞ্চ থেকে আসছে বড় পর্দায়। বহু বছর ধরে মঞ্চে দারুণ সাফ্যলের পর এবার অর্ণ মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও সোহিনী সরকারের হাত ধরে স্ক্রিনে জীবন্ত হয়ে উঠবে 'অথৈ', 'গোগো', 'দিয়া'। দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে শেক্সপিয়রের যে সমস্ত নাটক এখনও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক তাদের মধ্যে অন্যতম হল ‘ওথেলো’। সেই নাটক বাংলার সমাজ জীবনের চিত্রপটে প্রাণ পেয়েছে যার কলমের ছোঁয়ায়, সেই অর্ণ মুখোপাধ্যায় হিন্দুস্থান টাইমস বাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন বড় পর্দায় ‘অথৈ’-এর খুঁটিনাটির কথা।
'অথৈ'কে বড় পর্দায় আনার ভাবনা কীভাবে এলো?
অর্ণ: লকডাউনের সময় সকলেই মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত ছিলেন, আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই সময় একটানা সিনেমা এবং সিরিজ দেখতে দেখতে খুব একঘেঁয়ে লাগছিল। বারবার মনে হচ্ছিল যে সেরকম প্রোডাক্টিভ কিছু করতে পারছি না, বহুদিন মঞ্চে উঠতে পারছি না বা ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারছি না। তাই কিছু করার ইচ্ছে থেকেই 'অথৈ'-এর চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেছিলাম। তারপর আমি এবং অনির্বাণ 'ঘরে বাইরে' নামে একটি নাটকে অভিনয় করছিলাম। সেই সময় আমি ওঁকে এই চিত্রনাট্যটা শোনাই। আর ‘অথৈ’-এর সঙ্গে অনির্বাণ আগাগোড়াই জড়িয়ে আছে। তাই ওঁকে এটা শোনানো আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এছাড়া এ ধরনের শৈল্পিক আদান-প্রাদান আমাদের মধ্যে হয়েই থাকে। তো সবটা শুনে অনির্বাণ আমায় বলেছিলেন, "খাসা হয়েছে, চলো এটা নিয়ে ছবি করা যেতে পারে।"
প্রসঙ্গত বলি, অনির্বাণ অনেকদিন থেকেই আমাকে বলতেন, "তুমি কেন পরিচালনার কথা ভাবছো না?" আমি বলতাম, আমার একটু প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যাইহোক, তারপর অথৈ নিয়ে শ্রীকান্তদার সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়, উনি চিত্রনাট্য শোনেন, তারপর আমাদের শোও দেখতে এসেছিলেন। তারপর ঠিক হয় আমরা বড় পর্দায় 'অথৈ' আনব।
তার মানে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের তো বেশ একটা বড় ভূমিকা রয়েছে…
অর্ণ: হ্যাঁ, একেবারেই।
উনি তো এর আগে 'বল্লবপুরের রূপকথা', উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ অবলম্বনে 'মন্দার' পরিচালনা করেছেন, সবটা মিলিয়ে কি উনি কিছু ইনপুট দিয়েছেন পরিচালনার ক্ষেত্রে?
অর্ণ: পরিচালনায় ইনপুট নয়, কিন্তু অনির্বাণ এই ছবির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর, ফলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবটাই ওঁকে করতে হয়েছে। আমার সঙ্গে থাকা, বাজেট করা, প্রোডাকশনের সমস্ত কাজ দেখা, সবটা। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে আমি অভিনয় করব না। অনির্বাণ আমাকে পর্দায় এই চরিত্রটি করার জন্য জোর করেন। অনির্বাণ অভিনয়ের কথা বললে, আমরা হাউসের সঙ্গে বসে আলোচনা করি। এত বড় একটা অংশে আমাকে অভিনয় করতে হবে, তার উপর পরিচালনা, ফলে সবটা আমার একার পক্ষে সামলে ওঠা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে আমি আমার সঙ্গে অনির্বাণকে থাকতে বলি। তারপর থেকেই এই ছবির প্রত্যেকটা কাজে, সেটা পোস্ট প্রোডাকশন হোক বা প্রি-প্রোডাকশন, সমস্ত সময় আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। অনির্বাণ প্রচন্ডভাবে ছবিটার সঙ্গে জড়িত।
সত্যি কথা বলতে কি, এই ছবিটা যতটা আমার, ততটাই আমার টিমের। সেটা অনির্বাণ হোক বা আমাদের টিমের অন্যান্য সদস্যরা। প্রত্যেকেই এই ছবির কাজটা অন্য আর পাঁচটা ছবির কাজের মতো নেয়নি। আসলে শুরুতে ভাবনাগুলো হয়তো আমি ভেবেছি, কিন্তু আমার ভাবনাগুলো বাস্তবায়িত করা এবং সেই ভাবনার সঙ্গে আরও অনেক ভাবনা এসে যাওয়া, সেটা সকলে মিলে করেছে। ফলে এই ছবিটার জন্য আমি ওনারশিপ রাইট দাবি করতে পারি না। হ্যাঁ আমার নামটা পরিচালক হিসেবে যাবে ঠিকই, কিন্তু এই ছবিটা আমাদের সবার।
কিন্তু আপনি অভিনয় করতে চাইছিলেন না কেন? শুধুই কি পরিচালনার কারণে...
অর্ণ: হ্যাঁ, এটাই পরিচালক হিসেবে আমার প্রথম বড় পর্দায় কাজ। ফলে কাঁধে অনেকটা দায়িত্ব।
কিন্তু থিয়েটারে তো আপনি পরিচালনাও করতেন আবার চরিত্রটাও করতেন...
অর্ণ: থিয়েটারে আমি করেছি কিন্তু সেখানে আমার একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকে। আমি প্রথমে দৃশ্যপট ভালো করে দেখিনি, তারপর অভিনয় করি, কিন্তু সেই সুবিধা তো ছবিতে নেই। ছবিতে অভিনয়ের একটা নির্দিষ্ট চাপ রয়েছে, তার সঙ্গে এত বড় স্কেলের একটা ছবি পরিচালনা। ফলে দুটোর মধ্যে কোথাও গিয়ে ধাক্কাধাক্কি লাগতে পারে, এই জায়গাটা থেকেই আমি একটু দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু একেবারেই যে করবই না সেরকমটা নয়। বরং সিদ্ধান্তটা কিছুটা এরকম ছিল যে, না করলেই ভালো হয়।
কিন্তু এখন তো আপনাকে ছবিতে দেখতে পাচ্ছি, এক্ষেত্রে কি অনেকটা প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়েছিল?
অর্ণ: সাত বছর ধরে একটা চরিত্রের আত্মা আমি নিজের মধ্যে বহন করছি, এতগুলো শো হয়েছে। ফলে চরিত্রের মধ্যকার যে আত্মা সেটা এক ভাবে তৈরিই ছিল। কিন্তু ছবির ক্ষেত্রে সেটার জন্য আমাকে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় অ্যাডপট করতে হয়েছে। মঞ্চে একটা ক্রমবর্ধমান গ্রাফ থাকে, মন প্রস্তুত হয়ে যায় অভিনয় করতে করতে। কিন্তু সেটা তো ছবির ক্ষেত্রে হয় না, ফলে সে ক্ষেত্রে অভিনেতাদের একটা লড়াই থাকে। ছবির ক্ষেত্রে ক্রাফটের ব্যবহার একটু বেশি থাকে। দুটো মাধ্যমের দাবির কারণে ছোট ছোট কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। এছাড়া পর্দায় 'অথৈ' করতে গিয়ে যে অভিনেতা হিসেবে আলাদা করে খুব প্রস্তুতি নিতে হয়েছে তেমনটা নয়।
আর পরিচালনা, ছবিতে ডিরেকশন দিতে গিয়ে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হল?
অর্ণ: নির্মাণে সব থেকে বেশি আনন্দ পাই। মাধ্যমের তো একটা পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু থিয়েটার মঞ্চস্থ করার মধ্যে মায়ের প্রসব যন্ত্রণার মতন যে আনন্দ রয়েছে, ছবি করার ক্ষেত্রেও সেই একই আনন্দ রয়েছে। তবে পার্থক্য কেবল এই যে থিয়েটারে যখন ‘অথৈ’ নির্মাণ করেছি তখন আমাকে সময়ের জন্য সময়ের সঙ্গে দৌড় হতে হয়নি। সেটার মধ্যে নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয় ছিল। আমি অনন্তকাল অনন্তদিন ধরে একটা নাটক প্রস্তুত করতে চাইলে, করতে পেরেছি। কিন্তু ছবির ক্ষেত্রে আমাকে একটা নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলে তার আগে প্রস্তুতির জায়গাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্যুটিং করতে গিয়ে আমাকে সময়ের সঙ্গে দৌড়াতে হয়েছে। এইটাই দু'টো জিনিসের একেবারে বাস্তব জায়গা থেকে পার্থক্য। কিন্তু সমগ্রিক নির্মাণ করার যে আনন্দ সেটা দু'টোর ক্ষেত্রেই এক।
থিয়েটারের প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে, 'অথৈ' তো দর্শকরা থিয়েটারে দেখেছেন, ছবিতে তাঁরা নতুন কী পাবেন?
অর্ণ: মঞ্চের একটা প্রযোজনায় ভিস্যুয়াল আলাদা হয়, কালার টেক্সচার আলাদা হয় কিন্তু সেটা যখন একটা মাধ্যম থেকে আরেকটা মাধ্যমে যাচ্ছে তখন একটা বিপুল ডিপারচার ঘটে যায়। আলাদা কী দেব, তার থেকেও বড় কথা এটা স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা আলাদা মাধ্যম। ফলে এখানে তার ট্রিটমেন্ট আলাদা হতে বাধ্য। আমরা যখন মঞ্চে অথৈ আর গোগোকে দেখছি আর সেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে যখন একটা বিরাট ধান ক্ষেতের মাঝখানে দেখব সেই দুটো দৃশ্যই দৃশ্যগত দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে বলা যেতেই পারে মাধ্যমের জোরেই এটা একেবারে একটা নতুন জিনিস।
বেশ, কিন্তু ছবিতে যেহেতু 'অথৈ' দেখা যাবে, সেক্ষেত্রে মঞ্চে কি আবার নিয়ে আসার কোনও পরিকল্পনা রয়েছে?
অর্ণ: এখন, মানে অদূর ভবিষ্যতে মঞ্চে 'অথৈ' করার আমার কোনও পরিকল্পনা নেই। কয়েক মাসের মধ্যে তো একেবারেই নেই। পরে যদি ইচ্ছে করে, তখন আবার করব।
তাহলে কী মঞ্চ থেকে নাটকের ভবিষৎ বড় পর্দায়, এটা কি ট্রেন্ড? যেমন 'বল্লভপুরের রূপকথা'ও তো ভীষণ হিট হয়েছিল...
অর্ণ: না না আমি সেটা মনে করি না। এটা সারা পৃথিবীতে বহু বছর ধরে চলে আসছে এই বিষয়টা। বড় বড় পরিচালক যারা মঞ্চে নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন, তাঁরা সেই নাটক আবার বড় পর্দায় এনেছেন। সেরকম অনেক উদাহরণই রয়েছে। এটা বহু বছর ধরে চলে আসছে। তার মানে এটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে এটাই এখন ট্রেন্ড। আর সবচেয়ে বড় কথা হল সব নাটকের মধ্যে সিনেমাটিক ভ্যালু থাকে না, যে সমস্ত নাটকে তা থাকে সেগুলো নিয়েই ছবি হয় বা হচ্ছে। তবেই এটাই কেবল দর্শকরা পছন্দ করছেন এমনটা মোটেই নয়।
দর্শক প্রসঙ্গে একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে যে, বর্তমান সময়ে নাকি থিয়েটার নিয়ে তাঁদের উন্মাদনা বা আগ্রহ একটু কমেছে...
অর্ণ: আমি যখন থেকে থিয়েটার করতে শুরু করেছি তখন থেকেই মনে হতো যে, আগে বোধহয় ভালো ছিল। যতদিন থিয়েটার থাকবে ততদিন এই বিষয়টা থেকে যাবে। থিয়েটারের দিক থেকে যদি বলেন, তাহলে বলব থিয়েটার কখনওই একটা মাস আর্ট ফর্ম ছিল না। কিছু কিছু ব্যক্তি তাঁদের কাজ দিয়ে দর্শককে থিয়েটারে টেনেছেন। কিন্তু সেই ব্যক্তিদের সব নাটক নিয়েই দর্শকদের সমান উন্মাদনা কখনওই ছিলনা।থিয়েটারকে সবসময়ই সমাজের অন্য মাধ্যমের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। আমরা তো একটা লড়াই দেখে বড় হয়েছি, কিন্তু এখন তো লড়াইটা আরও কঠিন ১০ সেকেন্ডের রিলের সঙ্গে।
তবে আপাতদৃষ্টিতে হয়তো মনে হচ্ছে যে থিয়েটারে মানুষ আসছেন না, কিন্তু ছবিটা এমনও নয় যে মানুষ থিয়েটারকে বর্জন করেছেন। তবে আবার এমনটা নয় যে থিয়েটার থেকে আর্থিক ভাবে দারুণ লাভবান হওয়া যাচ্ছে। উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র থেকে শুরু করে পরেশ রাওয়াল একসময় তাঁদের কাজ দিয়ে বহু দর্শকে থিয়েটারে টেনেছেন। আবার এনাদের সব কাজেই যে তাঁরা এতটা সাড়া পেয়েছেন মানুষের থেকে তা কিন্তু নয়। ফলে, তারকা দিয়ে থিয়েটারের উন্মাদনা কখনও তৈরি করা যায়নি। থিয়েটার তার নিজের শক্তিতেই সাফল্য পেয়েছে, থিয়েটার তার নিজের কারণেই ব্যর্থ হয়েছে।
আপনি তো বহু বছর ধরে এই মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, আজকাল অনেক নবাগতার অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করতে আসছেন, তাঁদের বেশিরভাগটাই সিরিয়াল এবং সিনেমার দিকে ঝুঁকছেন, থিয়েটার দিকে নয়...
অর্ণ: হ্যাঁ, সেটা তো খুব স্বাভাবিক প্রবণতা। যারা নবাগত আসছেন তাঁরা যদি অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান তাহলে তো তাঁরা সিরিয়ালকেই বেছে নেবেন, তাঁরা সিনেমা করে পরিচিতি পেতে চাইবেন। এর মধ্যে তো আমি কোনও বিপদের সম্ভাবনা দেখছি না। এ তো খুব স্বাস্থ্যকর জিনিস। কিন্তু সমস্যাটা হয় তখন, যখন কেউ ভেবে নেন অভিনয় ব্যাপারটা আসলে খুব সহজ। কিন্তু যদি কেউ ট্রেনিং নিয়ে কাজ শিখে কাজটা করতে চান তিনি থিয়েটার দলে আসেন কাজ শেখেন, আবার অনেকে সিরিয়াল সিনেমা করেই কাজ শিখতে চান সেটা একেবারেই তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়।
বেশ, আর আপনার নতুন ছবি আসছে, সেখানে ওমকারা সঙ্গে যদি কোনও তুলনার জায়গা তৈরি হয়...
অর্ণ: বিশাল ভারদ্বাজের সৃষ্টি, অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যাডাপটেশন, তার সঙ্গে যদি কেউ 'অথৈ'-এর তুলনা করে তাহলে তো ভালোই লাগবে। একজন সাধারণ খেলোয়াড়ের ক্রিকেট খেলার সঙ্গে যদি শচীনের খেলার তুলনা করা হয় তাহলে তার আর কী চাই, সেটাই তো একটা কমপ্লিমেন্ট।