বাংলাদেশ উত্তাল। হাসিনা পদত্যাগ করার পরই স্বাধীনতার আনন্দে উল্লাস করছেন বহু বাংলাদেশী। সেই রেশ ধরে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের মূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে ঘটেছে আরও অনেককিছু। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হওয়ার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এই মুহূর্তে দেশের কী পরিস্থিতি, ঠিক কী ঘটেছে, সবটা Hindustan Times Bangla-র কাছে তুলে ধরলেন আজমেরি হক বাঁধন।
বাঁধন, যিনি শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন, ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ময়দানে নেমেছিলেন। ছাত্রদের এই জয়ে বাংলাদেশের মানুষের এই জয়ে তিনিও আজ ভীষণ খুশি। পুরো ঘটনা, সমগ্র বিষয় নিয়ে নিজের বক্তব্য জানিয়ে Hindustan Times Bangla-র কলম ধরলেন আজমেরি হক বাঁধন।
ঠিক কী বলেছেন বাঁধন?
'ছাত্র-জনতার আন্দোলন সফল হয়েছে। আর সেটা সফল হয়েছে একটা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটার মাধ্যমে। এই সফলতার পুরো কৃতিত্ব ছাত্রদের। রাষ্ট্র যে পরিমাণে মানুষকে হত্যা করেছে, যে পরিমাণ মানুষ আসলে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেখানে পুলিশ থেকে সাংবাদিক এবং ছোট্ট শিশুরাও রয়েছে আর ছাত্ররা তো আছেই। সেটার পরেও একটা আন্দোলন এই জায়গা পর্যন্ত পৌঁছেছে, সেটাই তো সফলতা। এই সফলতাকে আমি সাধুবাদ জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই ছাত্রদের ও যুব সমাজকে। আমরা যাঁরা দাসত্ব গ্রহণ করেছিলাম, অন্ধ হয়েছিলাম, নিপিড়ীত হয়েও চুপ করে ছিলাম, তাঁদের ভিতরের ভয়টাকে ওঁরা দূর করে দিয়েছেন। ছাত্রদের আন্দোলনের পর তাঁদের আহ্বানেই তো মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। আমি গত ১ অগস্ট থেকে প্রত্যেকদিন ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছিলাম। তাঁর আগে হয়ত আমিও রাস্তায় নামতে পারিনি, তবে আমার ভিতর ওই দমবন্ধকর একটা বিষয় তৈরি ছিল। তারপরই রাস্তায় নামি।
আসলে কোটা নিয়ে যা ঘটেছে, সেটা খুবই অনৈতিক ছিল। এই আন্দোলনে রাষ্ট্র যখন ছাত্রদের উপর গুলি চালালো সেটা মেনে নেওয়া কোনও স্বাভাবিক, সুস্থ মানসিকতার মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা মানা সম্ভব নয় যে ছাত্ররা নিজের অধিকার চাইছে বলে তাঁদের উপর গুলি চালানো হল! আর তারপর যেটা ঘটেছে সেটা তো আরও ভয়ঙ্কর! কারণ নির্বিচারে কয়েকশো মানুষকে গুলি করে মারা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে শিশু থেকে বাচ্চার মা অনেকেই আছেন। তখনই আমরা অনুভব করলাম যে আমাদের আসলে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত। বুঝেছিলাম, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললেই রাষ্ট্র নির্বিচারে মানুষ মারতে পারে। যদিও সেটা সরকারের তরফে স্বীকারও করা হয়নি। উল্টে কার্ফু জারি করা হল, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হল, যাতে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যাতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজেদের অবস্থা আমরা তুলে ধরতে না পারি। সরকারের তরফে বিভিন্ন ভুল তথ্য ছড়ানোও হচ্ছে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করাও হয়েছিল। আমাদের এখানে দুই-একটা বড় সংবাদমাধ্যম ছাড়া কেউ সত্য ঘটনা লিখতে পারছিলেন না। আর তাই সরকারের উপর, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছিল। কারণ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হয়েছিল শুধু শোষণ করার জন্য।
গত ১৫ বছর ধরে মাননীয় পেসিডেন্ট থেকে স্পিকার, শুধুই শেখ হাসিনার লোকজন নিযুক্ত হয়েছিলেন, তিনি নিজের মতো করে গোটা সিস্টেম চালিয়েছেন। এতদিন সকলেই শুধু তাঁর হয়েই কথা বলেছে। আর তাই আজ শোষিত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।
আমিও রাস্তায় ছিলাম, আমি তাই জানি, কারা কারা রাস্তায় নেমেছিলেন। ছোট ছোট শিশুও রাস্তায় নেমে পড়েছিল। এমনও দেখেছি শিশুরা লাঠি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, কারণ তারা ঠিক করেছিল প্রয়োজনে গুলি খাবে, বুক পেতে দেবে, তবে দেশকে এই স্বৈরাচারীর হাত থেকে তারা মুক্ত করবেই। তার ভাইদের যে মৃত্যু হয়েছে তার বিচার তারা করে তবেই যাবে। শিশু, ছাত্রদের সঙ্গে অভিভাবক, শিক্ষক সকলেই রাস্তায় নেমেছিলেন। এর সঙ্গে শিল্পী সমাজের একাংশ, ছোট ব্যবসায়ী থেকে রিক্সা চালক আরও অনেকে ছিলেন। কারণ ছাত্রদের চাওয়া ন্যায্য ছিল। ওঁদের আন্দোলন দেখেই আমরা সাহসী হয়েছিলাম। আমরাও তখন ভয় ভুলে রাস্তায় নেমে আসি। আমি আশারাখি, খুব শীঘ্রই গণতান্ত্রিক, নারীবান্ধব, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব।
আমি আরও বলতে চাই, এই আন্দোলনে সকলের আসলে একই দাবি ছিল, সকলেই জানতাম, আমাদের এটা থেকে মুক্তি পেতেই হবে। প্রতিবাদে আমরা লং মার্চ করেছিলাম, সেখানে আমিও ছিলাম। আমাদের এখানে টিভি চ্যানেল সেগুলো দেখায়নি, সেগুলো তো অন্ধত্ব গ্রহণ করেছিল, তারা অস্বচ্ছ ছিল। আমি মীরপুর সাড়ে১১ তে থাকি, মীরপুর থেকে বনানী হয়ে আমি গিয়েছিলাম গণভবনের দিকে। সেই লং মার্চে লক্ষ লক্ষ মানুষ হেঁটেছেন। সকলেই গণভবন মুখী ছিলেন, কারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ছাত্ররাই মানুষকে রাস্তায় নামার আহ্বান করে। জানলে অবাক হবেন, ছোট্টে একটা স্কুলের মেয়েও হাতে দুটো ইটের টুকরো নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, আমার হাত ধরে হেঁটেছে। ও বলেছে, গুলি খেয়ে মরে যাব, তবু আন্দোলন সফল করব।
আরও একটা কথা, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ক্ষমতা ছাড়তে চাননি, উনি সেনাবাহিনীকে আন্দোলন দমনের জন্য আরও কঠোর হতে বলেছিলেন। তারপর বিভিন্ন দফতর থেকে তাঁকে বুঝিয়ে, পরিবারের লোকজন বোঝানোর পর তিনি ক্ষমতা ছাড়েন, দেশ ছেড়ে পালান। সেটাও খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ওনার সরকারের লোকজন, পরিবারের লোকজনকে রাস্তায় ফেলে পালালেন। সেটা একইসঙ্গে দুঃখজনক এবং ভয়াবহ।
আসলে মানুষের মধ্যে অনেক আক্রোশ জমে ছিল। সকলে কিন্তু আমার মতো করে ভাববেন না, যে কেউ আঘাত করলে পাল্টা আঘাত করব না। তাই কিছু মানুষ আক্রোশ প্রকাশ করেছেন। কিছু সুবিধাবাদী মানুষ লুঠ করেছেন, কিছু সাম্প্রদায়িক, উগ্র চিন্তার মানুষ আছেন, যাঁরা এই আন্দোলনকে ঢাল বানিয়ে নিজেদের এজেন্ডাকে পূরণ করতে চেয়েছেন। জানি না, আমাদের এখানকার কিছু সংবাদমাধ্যম ছাড়া সকলে সঠিকটা দেখাচ্ছেন কিনা! ওঁরাও তো অন্ধ হয়ে গিয়েছে।
গতকাল কিন্তু সেনাবাহিনী নয়, ছাত্ররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে, বিভিন্ন মন্দির-মসজিদে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যাঁরা নৈরাজ্য তৈরি করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। আমাদের প্রশ্ন, মাননীয়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী যখন পালিয়ে গিয়েছেন, তখন পুলিশ থেকে সামরিক বাহিনী কেন মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পথে নামেননি? প্রশ্ন তাহলে ওঁরাই কি ইচ্ছা করে নৈরাজ্য তৈরি করে দেখাতে চাইছেন, যে তিনি না থাকলে কিছুই হবে না! তবে সেই পরিকল্পনা ছাত্র ও জনতা ভেস্তে দিয়েছে। তাঁরাই পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার চেষ্টা চলছে। এমনকি ছাত্ররা অসম্ভব ভালো কাজ করছেন। গণভবনে যে লুঠপাঠ হয়ে সেগুলো মানুষ ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, গণভবন, সংসদভবন সবই পরিষ্কার করা হচ্ছে।
আশা করছি, ডঃ মহম্মদ ইউনুস প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে থাকবেন, তাঁরা ছাত্রদের সঙ্গে বসে অন্তর্বতী সরকার গঠন করবে। যেখানে ছাত্রদের মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে হ্যাঁ, যে ধরনের সহিংসতা ঘটেছে সেটার জন্য আমরা অবশ্যই দুঃখিত। আমি চাই এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকুক, এখানে কেউ সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নন। বাংলাদেশে যাঁরা জন্মেছেন, দেশটা সবার, আমরা সবাই বাংলাদেশী। আমরা হিন্দু-বৌদ্ধ-ক্রিশ্চান-আদিবাসী, কেউ আলাদা নই। আমরা এমন রাষ্ট দেখতে চাই, যেখানে কোনও বৈষম্য থাকবে না। ছাত্রদের স্পিরিটকে কাজ লাগাতে পারলে, তাঁরাই আমাদের পথপ্রদর্শক হবেন। আমি এবং আমরা বারবার বলছি আমরা ছাত্রদের কাছে কৃতজ্ঞ।
আমি আরও বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু কিন্তু আসলে কারোর একার বাবা নন, তিনি কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট কোনও দলের নেতা নন, উনি আমাদের সবার। আমারা বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করি, ওঁর জন্য আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। উনি আমাদের জাতির পিতা। তাঁকে যেভাবে অপমান করা হয়েছে, সেটার দায়ভার আসলে তাঁরই সন্তানের, তাঁর কন্যার, তাঁদের স্বৈরাচারী আচরণের। তাঁদের শোষণের জন্যই বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণের স্বীকার হতে হয়েছে, যা অবশ্যই দুঃখজনক, এজন্য ধিক্কার জানাই। বঙ্গবন্ধুকে আমরা সকলেই হৃদয়ে ধারণ করি।