বাংলার বক্স অফিসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে 'খাদান'। ছবি ব্লকবাস্টার হওয়ার পথে…। আর তাই এই মুহূর্তে চর্চায় রয়েছেন দেব-যিশু, ইধিকারা। তবে এই ছবির রূপকার যিনি তিনি হলেন পরিচালক সুজিত দত্ত রিনো। তাঁর হাত ধরেই বড়পর্দায় উঠে এসেছে কয়লাখনি এলাকার এই গল্প। ছবির সাফল্য, দেব-যিশুর মতো সুপারস্টারের সঙ্গে কাজ, ছবি তৈরির নানান অজানা কথা Hindustan Times Bangla-র সঙ্গে ভাগ করে নিলেন পরিচালক সুজিত রিনো দত্ত।
কয়লাখনি এলাকায় বড় হয়েছেন বলে শুনেছি, সেখান থেকে 'খাদান' গল্প তৈরির গল্পটা যদি বলতেন?
সুজিত রিনো দত্ত: খাদান-এর গল্পটা অনেক পরে লিখেছি, তবে এর আগেও কয়লাখনি এলাকার গল্প নিয়ে আমি কাজ করেছি। কয়লা খনি এলাকাতেই তো আমার বড় হওয়া। ছোট থেকেই খনি এলাকার নানান রোমাঞ্চকর, অদ্ভত সব গল্প শুনেছি। ২০১৫-তে এসে ভাবলাম খনি এলাকার কোনও গল্প নিয়েই ছবি বানাব। আর মনে মনে গল্প তৈরি করতে শুরু করলাম। তবে বাইরে থেকে শোনা গল্পে মনে মনে তার ছবি এঁকে, এমন একটা বিশ্বের মধ্যে ঢুকে পড়া কিন্তু মোটেও সহজ নয়।
খাদন-এর আগেও অবশ্য কয়লা খনির প্রেক্ষাপটে অন্য গল্পও তৈরি করার চেষ্টা করেছি, তবে হয়ে ওঠেনি। এভাবেই নানান গল্প নিয়ে কাজ করতে করতে ‘খাদান’ লিখি ২০১৮-১৯-সালে এসে। অবশ্য এর অনেকটা পড়ে আমি এই ছবিটা নিয়ে দেবের কাছে এসেছিলাম। আর অবশেষে ছবিটা মুক্তি পেয়েছে, হলে চলছে।
‘খাদান’ করার প্রস্তাব কি প্রথমেই দেবকেই দিয়েছিলেন?
সুজিত রিনো দত্ত: হ্য়াঁ, এই ছবির প্রস্তাব নিয়ে আমি দেবের কাছেই গিয়েছিলাম। আসলে এর আগে আমার City of Jackals রিলিশ করেছিল ২০২২-এ। তখন সেই ছবি ডিস্ট্রিবিউশন করতে গিয়ে খুব চাপে পড়েছিলাম। তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম, ছবি করলে বড় করে, বড় হাউসের সঙ্গেই করব। আর বড় পর্দার ম্য়াজিক ক্রিয়েট করার বিষয়টা আমাকে খুবই টানে। আর এই ছবিটা ইন্ডিপেনডেন্টভাবে করা সম্ভবও ছিল না। আর বাংলায় ডিস্ট্রিবিউশনের বিষয়টা একটা অন্য পৃথিবী, চাপের, তাই আর রিস্ক নিইনি। শুধু ছবিটা ভালোভাবে করতে চেয়েছিলাম, সেটাই আমার একমাত্র চাওয়া ছিল।
আর 'খাদান' আমি বড় করেই করতে চেয়েছিলাম, তার জন্য বড় কোনও নাম, দেবের মতো সুপারস্টারকেই প্রয়োজন ছিল। ছবি বানানোর যা বাজেট, তার ভার বহনের জন্য বড় প্রযোজনা সংস্থা ছাড়া সম্ভব হত না। দেব ছাড়া এটা কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না।
নিজের চোখে দেখা কোনও গল্প থেকে তৈরি বলেই কি 'খাদান'-কে এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা সহজ হয়েছে?
সুজিত রিনো দত্ত: আসলে কয়লাখনি এলাকার অনেকগুলো গল্পই আমি লিখেছি, তারই মধ্যে একটা হল 'খাদান'। রিয়েল লাইফ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চরিত্রগুলো তৈরি করেছি। মনস্তত্বকে, সেন্টিমেন্টকে রিয়েল লাইফ থেকে নিয়েছি, কয়লাখনির পটভূমিকে ব্যবহার করেছি, তবে তারপরেও গল্পটা কিন্তু আসলে কাল্পনিক। কারণ, এটা তো ডুকেন্টরি নয়। তাই ছবির পুরো গল্পটাই আমার চোখে দেখা ঘটনা, তেমনটা কিন্তু নয়। বলতে পারি, আমি শুধুমাত্র কয়লা খনির একটুকরো সেলকে এখানে তুলে ধরেছি। কয়লার প্রথমস্তরে যেটা থাকে, যেটাকে দেখতে খানিকটা কয়লারই মতো, তাকে সেল বলে। তেমনই খনি এলাকার একটা ছোট্ট একটা বিষয় আমি তুলে ধরেছি বলতে পারেন। এখনও কয়লা অঞ্চলে তো সেভাবে ঢুকিও নি, সেটা অনেক গভীর। (হাসি)
দেবের মতো সুপারস্টারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন?
সুজিত রিনো দত্ত: উনি যে সুপারস্টার সেটাই তো বুঝেই উঠতে পারি নি। অনেক পড়ে প্রমোশনের সময় গিয়ে বুঝলাম, উনি কতবড় সুপারস্টার। দেব খুবই সাধারণ, মধ্যবিত্ত বিষয়টাই ওঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে। আর কাজের সময় যখন ক্যামেরার বিপরীতে থাকি, তখন আমার কাছে সকলেই একইরকম। তবে হ্যাঁ, কোনও কোনও সুপারস্টারের অনেক ট্যানট্রাম থাকে, তাঁরা স্টারডম বিষয়টা জানান দেন। তবে দেবের মধ্যে ট্যানট্রাম বিষয়টাই নেই। দেবের মধ্যে মাটির গন্ধটা এখনও আছে। যিশুদাও তাই, খুবই সাধারণ। আর কোনওটাই আরোপিত নয়।
ফ্লোরে যাওয়ার আগেও দেবদার সঙ্গে লম্বা সময় কাটিয়েছি, মিশে গিয়েছিলাম। তবে প্রমোশনে গিয়ে বুঝলাম, উনি কতবড় সুপারস্টার। ওঁকে একটিবার দেখার জন্য মানুষ কতটা পাগল, কেউ তো আবার মাথা ঘুরেই পড়ে গেলেন!

যিশু নাকি দেব, কার সঙ্গে কাজ করাটা বেশি সহজ মনে হয়েছে?
সুজিত রিনো দত্ত: ব্যক্তিগত পরিসর থেকে দেবের সঙ্গেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি। কাজের জায়গায় আলাদা করে কিছুই বুঝিনি, বা ভাবিনি যে আমি কার সঙ্গে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য! সহজেই কাজ করেছি। আর সাজিয়ে গুছিয়ে আমি কথা বলতে পারিনা, তাই এতটুকুও বাড়িয়ে আমি বলছি না, বিশ্বাস করতে পারেন…।
আপনার পরিচালনায় 'খাদান' সুপারহিট, বহুদিন পর আপনার হাত ধরে বাংলা বাণিজ্যিক ছবি আবারও নিজস্ব ছন্দে ফিরল, কী বলবেন?
সুজিত রিনো দত্ত: দায়িত্ব আরও বাড়ল। ভালোলাগার যেটা বিষয় সেটা হল দর্শক 'খাদান' ছবিটা সেলিব্রেট করছেন। মাঝেও কিন্তু বেশকয়েকটা ছবি ব্লকবাস্টার হয়েছে। তবে কোনও ছবি নিয়ে এত সেলিব্রেশন হয়নি। আর দর্শকরা যতক্ষণ না কিছু সেলিব্রেট করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রিতে কনফিডেন্স ফেরে না। হয়ত মনে হবে, এই ছবিটা চলে গেছে, ঠিকই আছে…। গোটা বিষয়টা কেমন ঝিমিয়ে থাকে। অডিয়েন্স যখন সেলিব্রেট করা শুরু করেছেন তখনই গিয়ে বাজারটা পজিটিভ হয়েছে। এতে বিনিয়োগ বাড়বে, আরও ভালো কাজ হবে। অনেকেই এবার ভাববেন হ্য়াঁ, অডিয়েন্স আছে, আমরা এমন একটা ছবি করতেই পারি।
তাহলে ক্রেডিটটা কাকে দেবেন?
সুজিত রিনো দত্ত: এর অনেকটা ক্রেডিট খানিকটা আমাদের দেওয়া উচিত কেজিএফ, জওয়ান, পাঠান, এই ছবিগুলোকে। এরাঁf আমাদের এখানেওই ‘মাস ফিল্ম’-এর অডিয়েন্সকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। যে জোয়ারটা ওঁরা তুলেছিল, তারই একটা অংশ আমরাও নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। আর এটাই ঘটেছে। এধরনের ছবি গত ১০-১২ বছরে হয়নি। বাংলার দর্শক বহুদিন এভাবে বাংলা বাণিজ্যিক ছবি হলে গিয়ে দেখেননি। এদিকে অনেকেই কিন্তু হিন্দি, দক্ষিণী মাস ফিল্ম দেখতে হলে গেছেন। তবে এখানে মাটিটা কিন্তু ছিল, আমরা বাংলার মাটিটাকেই ওই মোড়কে বেচেছি। কলকাতা থেকে দূরে গিয়ে একটা অঞ্চলের মাটির গন্ধটা তুলে ধরলাম, সেটা দরকার ছিল। আঞ্চলিকতাই আসলে আন্তর্জাতিক বিষয়, এটাই আমাদের সাফল্য দিয়েছে।
দেব যেভাবে মূলধারার বাংলা বাণিজ্যিক ছবিকে ফিরিয়ে আনলেন, সফল করলেন, দেবকে তি তাহলে 'বাংলার শাহরুখ' বলতে পারি?
সুজিত রিনো দত্ত: 'বাংলার শাহরুখ', 'দক্ষিণের শাহরুখ' এই তকমা গুলোতে আমি ঠিক বিশ্বাস করিনা। তবে হ্য়াঁ, বিষয়টা খানিকটা এমনই। দেব ভয়ানকভাবে ক্রাউড পুলার, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। দেবের মধ্যে একটা অন্য ম্য়াজিক আছে। তবে এই ম্য়াজিকটার জন্য মশালাটাও প্রয়োজন, ঠিকভাবে সেই মশলাটা দেওয়া হচ্ছিল না। এই ছবিটা অন্য কেউ করলে, এভাবে হিট নাও হতে পারত। স্টার ছাড়া কিছু হয় না, স্টার ছাড়া ইন্ডাস্ট্রি এগোয় না। সারা পৃথিবীতে যেখানে যেখানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এগিয়েছে, সেখানে কিন্তু এই 'স্টার' সিস্টেমের হাত ধরেই এগিয়েছে। ইউরোপ খুব ভালো ছবি বানায় তবে গর্ভমেন্ট ফান্ডিং-এ ছবি হয়, ওখানে কোনও স্টার নেই। হলিউড, কোরিয়া, চিন স্টার তৈরি করেছে। কারণ, সাধরণ মানুষ আসলে তারকার ঘাড়ে চেপে সেলিব্রেট করতে চান।
এখন অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী উঠে আসছেন, স্টার কিন্তু সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। এটা সিনেমাহলেই একমাত্র সম্ভব। খুব ব্যস্ত মানুষও সিনেমাহলে গিয়ে খাদান দেখেছেন, এটা ভালো লাগছে। অনেক অবাঙালি মানুষও হলে গিয়ে খাদান দেখেছেন। আমার অনেকে নিজে বলেছেন ‘পয়সা ওসুল ফিল্ম, এয়সা হোতা হ্যায় কেয়া বাংলা পিকচার?…’
'খাদান' হিট হওয়ার পর পরিচালক হিসাবে কি একটু হলেও কি বেশি আত্মবিশ্বাসী?
সুজিত রিনো দত্ত: আমি উপরওয়ালার কাছে কৃতজ্ঞ। তবে একটু হলেও তৃপ্ত তো বটেই। যা ভেবেছিলাম, তার কিছুটা পেয়েছি, সবটা নয়। আমি কিন্তু এটা নিয়ে আগেই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, জানতাম হিট হবে। তবে এতটা হবে, এভাবে মানুষ ছবিটা সেলিব্রেট করবেন, সেটা ভাবিনি। তবে জানতাম, এধরনের ছবির অডিয়েন্স আছে।
ছবি হিট, আবার দেব- ইধিকা ছবিও হিট, ইধিকা পালকে কে বেছেছেন?
সুজিত রিনো দত্ত: দেবকে যখন গল্পটা বললাম, এই চরিত্রের মতো করেই অভিনেতা খুঁজছিলাম। তো দেবদাই একদিন ইধিকার কথা বললেন। ইনস্টা রিল বা কিছুতে দেখে ইধিকাকে এই চরিত্রের জন্য দেবদাই পছন্দ করেন। এরপর অফিস থেকে যোগাযোগ করা হয় ওঁর সঙ্গে। আমার সঙ্গে ইধিকার আলাপ করানো হয়। তখনই বুঝেছিলাম, উনি এই চরিত্রের জন্য উপযুক্ত। ওঁর মধ্যে আটপৌরে, মাটির গন্ধটা আছে, আবার সুন্দীরও।
রুক্মিণী কী বললেন ছবি দেবে?
সুজিত রিনো দত্ত: উনিও ছবির সাফল্যে ভীষণ খুশি। তবে ছবি দেখেছেন কিনা এটা আমি ওঁকে কিছু জিগ্গেস করিনি।
আপনার পরের ছবিতেও কি দেব?
সুজিত রিনো দত্ত: এই রে! এটার জবাব সময়ই দেবে। পরের গল্প রেডি কিনা জানি না, তবে কয়লা নিয়ে অনেক গল্পই আমার তৈরি আছে। কোনটা কী করব, ভাবিনি এখনও। আগে এই সময়টা কাটিয়ে উঠি, তারপর নাহয় ভাবব। আপাতত পরিবারকে একটু সময় দিতে চাই। ইচ্ছে তো শাহরুখ খান, কমল হাসানের সঙ্গে কাজ করারও আছে। কতটা কী হবে, সময় সব বলবে…