স্মৃতি বুকে করে নিয়ে ওপার বাংলা থেকে একদিন স্বামীর হাত ধরে কলকাতায় চলে এসেছিলেন ইন্দুবালা। তারপর তাঁর আর ফিরে যাওয়া হয়নি। 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল' ওয়েব সিরিজের সেই গল্প মন ছুঁয়েছে দর্শকদের। ইন্দুবালার জীবনের গল্পকে আরও বেশি মর্মস্পর্শী করে তুলেছে ওয়েব সিরিজের গান। 'ধিকি ধিকি', 'দেহতরী', 'পাখিদের স্মৃতি', 'আমি একা চিনি' গানের কথা ও সুর দর্শক ও শ্রোতাদের চোখে জল এনেছে। তবে এই সবগানে যিনি সুর দিয়েছেন সেই অমিত চট্টোপাধ্যায়ের কাজকে মোটেও ভালো চোখে নেননি বাংলার সিনিয়ার সুরকাররা। তাঁকে ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছিলেন কেউ কেউ। ঘটনার পরপর এনিয়ে সরব হয়েছিলেন অমিত। সম্প্রতি হিন্দুস্তান টাইমস বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে, ঠিক কী কী ঘটেছিল, তা নিয়ে বিশদে কথা বললেন সুরকার অমিত।
ঠিক কী ঘটেছিল?
অমিত: প্রথম গান মুক্তির পর থেকে ঘটনাটা শুরু হয়। বিভিন্ন নম্বর থেকে হুমকি ফোন আসতে থাকে। একজন খুব নামী ডিরেক্টর আমার সম্পর্কে বিভিন্ন জায়গায় খারাপ কথা বলতে শুরু করেন। আমি ওঁর নাম নিতে চাই না। কারণ, এটা খুবই দুঃখের। আমাদের এখানে নতুনদের উঠতে গেলে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। পুরনোরা, যাঁরা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত তাঁরা অনেক সমস্যা তৈরি করতে থাকেন, হয়ত জায়গা হারানোর ভয় পান। প্রযোজকদের কাছে গিয়ে নানানভাবে কাঠি করতে শুরু করেন। এটা আগেও হয়েছে আমার সঙ্গে। শুধু আমি কেন, আরও অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বলা ভালো এটাও একধরনের মাফিয়ারাজ ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বড় কিছু মিউজিক ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করতে গেলে গায়ক-গায়িকাদেরও সমঝোতা করতে হয় অনেক আমার চোখের সামনেই এমন অনেক ঘটনা দেখেছি। বরং নতুনরা মিউজিক ডিরেক্টররা নতুন, পুরনো সকলের সঙ্গেই কাজ করতে চান।
ফোনে কী হুমকি পেয়েছিলেন?
অমিত: আমাকে ফোনে বলা হয়, বাংলা সিনেমা, ওয়েব সিরিজে মিউজিক করা যাবে না। আমি বললাম, তাহলে কী করব? বলা হল অন্যের হয়ে অ্যারেজমেন্ট করো, মিক্সিং করো। আমি সেসময় ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। আমার পরিবারের লোকজন আমায় বলেন, ওঁরা বড় মানুষ, ঝামেলায় জড়াস না, ছেড়ে দে। একটা সময় ধরেই নিয়েছিলাম, আর মিউজিক করব না। তখন যদিও আমার হাতে ছিল ‘আবার প্রলয়’, 'রক্তবীজ'-এর কাজ রয়েছে। ভেবেছিলাম, এরপরে আর কোনও কাজ ধরব না। আমি থানায় অভিযোগ জানাই। শুধু আমায় নয়, আমার গান যাঁরা গেয়েছেন, তাঁদেরও কয়েকজনকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা হয় কেন আমার গান তাঁরা গেয়েছেন! আমাকে #MeToo -তে ফাঁসানোর হুমকিও দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-‘ইন্দুবালা’র গান প্রথমে প্রযোজকদের পছন্দ হয়নি, বলেই দিয়েছিল চলবে না: অমিত
#MeToo! কিন্তু কেন!
অমিত: ফোনে আমি পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম যদি গান বানাই তাহলে কী হবে? তখন অপরদিক থেকে বলা হয় #MeToo কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে। সত্যিই এধরনের কিছু ঘটলে বিষয়টা খুবই অসম্মানজনক। তাই কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। ইন্ডাস্ট্রিতে আসলে কিছু লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কাজ, জায়গা হারানোর ভয় পান। তবে সবাইকেই এটা মানতে হবে, একটা সময়ের পর কারোরই গানই হয়ত গান চলবে না। সৃষ্টি হলে ধ্বংসও হয়। আমাকেও অবসর নিতে হবে। কেউ কেউ ভাবেন আমিই শুধু কাজ করে যাব সারাজীবন, তা হয় না।
শুনেছি নাকি কিছু মিউজিক ডিরেক্টর, সঙ্গীতশিল্পীরা পার্টিতে গিয়ে কাজ আদায় করেন? এটা সত্যি?
অমিত: হ্যাঁ, পার্টি করে কাজ আনছেন এমন সঙ্গীত পরিচালক, শিল্পীরাও আছেন। আসলে ওঁরা জানেন এটাই বোধহয় কাজ পাওয়ার ধরণ। ওঁরা ভাবে এটাই সিস্টেম। আমি এমনও দেখেছি পানীয়র গ্লাস হাতে প্রযোজককে খুশি করতে পার্টিতে গান শোনাচ্ছেন এক সঙ্গীত পরিচালক। তবে আমি এটাতে বিশ্বাসী নয়। আমার দ্বারা এসব হবে না। কাজ পেতে এসব কখনওই করতে পারব না। এই ঘটনার পর কারোর সঙ্গে দেখাও করি না।কে কোথায় কখন ফাঁসিয়ে দেয়।
ইন্ডাস্ট্রিতে বন্ধু নেই আপনার?
অমিত: খুব কাছের, আড্ডা দি, এমন বন্ধুর সঙ্গে আমার ইন্ডাস্ট্রিতে খুবই কম। তবে দেবালয়দা ( পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য)র সঙ্গে আমার কাজের বাইরেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমরা আড্ডা দি। এছাড়া পরিচালক অরিত্র মুখোপাধ্যায় (ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি-র পরিচালক)-এর সঙ্গেও আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব। একসময় আমরা একসঙ্গে সাইকেলিং করতাম। আর বন্ধু তেমন কেউ নেই। পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। উনি সবসময়ই আমায় ভালো পরামর্শ দিয়েছেন।
এধরনের হুমকি, খারাপ সময়ে ইন্ডাস্ট্রির কাউকে পাশে পাননি?
অমিত: হ্যাঁ, তা পেয়েছি। অনেকেই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সৃজিত মুখোপাধ্যায়, সংলাপ ভৌমিক, অনুপম রায় সহ আরও অনেকেই সাহস দিয়েছিলেন। আর দেবালয়দা তো আছেনই।