স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। টলিউডের এই চর্চিত অভিনেত্রী এখন গোটা দেশে চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে,সৌজন্যে আমাজন প্রাইমের নতুন ওয়েব সিরিজ পাতাল লোক। যা প্রযোজনার দায়িত্বে রয়েছেন অনুষ্কা শর্মা। স্বস্তিকা থেকে ডলি মেহরা হয়ে উঠবার সফর, পাতাল লোকের সাফল্য থেকে মুম্বইয়ে লকডাউন লাইফ সব কিছু নিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস ডিজিটালের সঙ্গে আড্ডা দিলেন স্বস্তিকা।
পাতাল লোক,তোমার প্রথম হিন্দি ওয়েব সিরিজ। লকডাউনে গোটা দেশে এটা নিয়েই এখন কথা হচ্ছে। এত প্রশংসা।এতকিছু খারাপের মধ্যেও একটা দারুণ খবর বলা যেতে পারে?
আমার খারাপ খবর, আর খারাপ সময় ডিসেম্বর থেকেই চলছে। সেই সময় থেকেই আমি ঘরবন্দি। তখন থেকেই বাবার অসুস্থতার জন্য হাসপাতাল আর ডাক্তার ছাড়া কোথাউ যেতে পারিনি।(মার্চ মাসেই প্রয়াত হন অভিনেত্রীর বাবা সন্তু মুখোপাধ্যায়) এইরকম খারাপ,হোপলেস একটা সময়ে ১৫ তারিখ থেকে সবকিছু কেমন পাল্টে গেল। আমি এক আগে এত টেনশন করছিলাম, ১৪ তারিখ মধ্যরাতে(পাতাল লোক)রিলিজের পর আমি নিজে দেখিনি। ডলি মেহরার পুরো অ্যানসাইটি আমার মধ্যে চলে এসেছিল। আমি বন্ধুদের,বোনকে বলেছিলাম তোরা ফিডাব্যাক দিবি আগে,তারপর আমি দেখব। আমি কোনওদিনই শ্যুটিংয়ের সময় মনিটর দেখি না,এটা আমার অভ্যাস। আর এটা যেহেতু সিঙ্ক সাউন্ডে তৈরি,তাই ডাবিংয়েও নিজের কাজটা দেখার সুযোগ হয়নি।ভীষণ টেনশনে ছিলাম।
‘দ্য বিদ্যা বালান’ পাতাল লোক দেখে আপানকে ফোন করেছিল, দারুণ খুশি, তাই তো?
ভীষণ আপ্লুত। মানে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।বিদ্যার ফোন পেয়ে আমি এতটাই অবাক আর উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে আমি কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি ওঁনাকে ভালো করে থ্যাংক ইউ পর্যন্ত বলতে পারিনি। তবে ফোন রাখবার ঘন্টাখানেক পর ধাতস্থ হয়ে মেসেজ করে ওঁনাকে ধন্যবাদ জানালাম। বিশ্বাসই করছিলাম না যে বিদ্যা বালান আমাকে ফোন করেছে। ভাবলাম কানে ভুল শুনছি,ট্রু কলারে ভুল নম্বর দেখাচ্ছে! উনি এত ডিটেলসে সবটা বললেন.কোনটা ভালোলেগেছে,তখন বুঝলাম না সত্যি উনি ফোন করেছেন।
অনুরাগ কশ্যপ বলেছেন ‘এখন পর্যন্ত ভারতের সেরা ক্রাইম থ্রিলার পাতাল লোক’, গোটা টিমের জন্য বিরাট পাওনা?
সাংঘাতিক খবর। আমাদের পরিচালক প্রসিত (রায়) বলল,অনুরাগ কশ্যপ ওকে ফোন করেছিলেন, খুব প্রশংসা করেছে। এটা সত্যি বড় প্রাপ্তি। একটা শোয়ের সাফল্য তো শুধু অভিনেতা বা পরিচালকের ক্রেডিট নয়। এটা একার নয় গোটা টিমের সাফল্য। রাইটার,ক্রিয়েটার,ডিওপি সবাই এটার সঙ্গে জড়িত।সবাই নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছে। ক্নিনস্লেট এবং আমাজনেরও বাহবা প্রাপ্য। এই সিরিজটা প্রোডিউস করবার জন্য। আমাদের দেশের এইরকম এটা ভয়াবহ,মর্মান্তিক সত্যটা তুলে ধরতে অনেকেই এখন ভয় পায়। সত্যটা দেখানোর সাহসটা সবাই পায় না। সেখানে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত এত বড়োমাপের একটা মানুষ যখন নিজের কাজ ছাপিয়ে প্রশংসা করেন সেটা খুব এক্সাইটিং। আমাদের দেশে এই জঁর নিয়ে বা ক্রাইম থ্রিলার নিয়ে কথা বলা হলে অনুরাগ কশ্যপের নাম সবার প্রথমে আসে।তিনি যখন নিজের কাজের থেকে এই কাজটা উচ্চ জায়গায় রাখছেন সেটা সত্যি ভালো লাগে।
ভারতে মহিলা প্রযোজক হাতে গোনা,সে জায়গায় মেনস্ট্রিম ছবির নায়িকা অনুষ্কা শর্মা প্রযোজক হিসাবে এইরকম বোল্ড কনটেন্ট নিয়ে কাজ করছেন। কী বলবেন?
অনুষ্কা খুবই সাহসী মহিলা। অনুষ্কার একটা খুব ভালো টিম রয়েছে, যাঁরা ওকে সাহায্য করে, ওঁরা ভালো কনটেন্ট নিয়ে কাজ করে। বিশেষত ওঁর ভাই কার্নেশ।আমাদের শ্যুটিংটা ওর তত্ত্বাবধানেই হয়েছে। ওরা চায় এমন সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করতে যেটা সমাজকে একটা বার্তা দেবে। সব শিল্প মাধ্যমের মধ্যে সিনেমা হল এমন একটা মাধ্যমে যার দ্বারা মানুষের সঙ্গে সহজে সংযোগ স্থাপন করা যায়। সমাজের উলঙ্গ চেহারাটা দেখানোর জন্য সিনেমাটা সবচেয়ে বড় রোল প্লে করে। এখানে এন্টারটেনমেন্ট তো নিশ্চয় রয়েছে কিন্তু তার বাইরেও কিছু দায়িত্ব থেকে যায়।সামাজিক দায়িত্বের কথাটাও ভাবতে হয়। সেটা ভেবে ক্লিনস্লেট (অনুষ্কার প্রযোজক সংস্থার নাম) কাজ করছে। ধরলাম মাছ না ছুঁই পানি এই রকম অ্যাপ্রোচ নয় অনুষ্কার।যেটা যেভাবে দেখানো উচিত সেটা সেইভাবেই দেখাচ্ছে। আমি মন থেকে ওকে অভিনন্দন জানাতে চাই। এবং আশা করছি ভবিষ্যতেও ও এইরকম কাজ করে যাবে।
তোমাদের সিরিজের একটা ডায়লগ খুব ফেমাস, ‘When A dog love's a man,he's good man, when a dog love's a man he's a good man'- তুমি নিজেও এটা বিশ্বাস কর?
যারা কুকুর-বেড়াল বা কোন প্রাণীকে ভালোবাসে না আমার ব্যক্তিগতভাবে তাদের নিয়ে একটু আপত্তি আছে। আমি জাজমেন্টাল হব না,কিন্তু আমি ভাবব।আমি একটু প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে তাঁদের দেখি যাঁরা অবলাদের সাংঘাতিক অপছন্দ করে। তাদের আশেপাশে থাকতে আমি কমফর্টেবল নই। ভয়টা অন্য জিনিস, কিন্তু পছন্দ না করাটা অন্য জিনিস। আমার তো প্রচুর বন্ধু আছে যারা কুকুরকে ভয় পেত আমার পাল্লায় পরে ডগ লাভার হয়ে গেছে।
৯ এপিসোডে আপনি তো মূলত নীরজ কবির সঙ্গেই স্ক্রিন শেয়ার করেছেন। কিন্তু বাকিদের দেখে দর্শক হিসাবে কেমন লাগল?
আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র চিনি। আমি তো মন খারাপে মরে গিয়েছিলাম শেষ এপিসোডে। প্র্যাটিক্যাল জ্ঞান হারিয়ে আমি শুধু প্রার্থনা করছিলাম সুদীপ শর্মা (পাতাল লোকের ক্রিয়েটিভ হেড) স্ক্রিপ্টে এমন কিছু একটা করুক যাতে চিনি ছাড়া পেয়ে যায়। আমার মেয়ের সামনে এত ঘ্যানঘ্যান করছিলাম যে ও বিরক্ত হয়ে গেছে। সে বিরক্ত হয়ে আমাকে বলছে মা তুমি তো আগে থেকেই জানো কেন এমন করছো! কেন কান্নাকাটি করছো? আমি জোরেজোরে চিত্কার করছিলাম ভগবান কিছু একটা করো, যাতে চিনি ছাড়া পেয়ে যায়। চিনির লাস্ট ডায়লগটা আমার বুকে বিঁধেছে। যখন ও বলল ‘আমি টাকা জোগাড় করছিলাম যাতে অপারেশন করে তোকে বিয়ে করতে পারি’! তখনই ওর পুরো জার্নিটা চোখের সামনে ভেসে উঠে।চিনি আমার মনকে সবচেয়ে নাড়া দিয়েছে। সবার কথাই বলতে হয়,সকলে খুব দুর্ধর্ষ করেছে। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছিল সারাজীবন ধরে এই চরিত্রগুলোই যেন তাঁরা প্লে করে চলেছে। এত অপূর্বভাবে সবাই নিজেদেরকে ভুলে চরিত্রগুলো হয়ে উঠতে পেরেছে ভাবা যায় না। তবে সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছি চিনির জন্য।
করোনা সংকটে এখন অনেক বড়ো ব্যানারের বলিউড ছবি OTT প্ল্যাটফর্মে রিলিজ করছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মই কী ভবিষ্যত, কী মনে করছো?
দেখ, এই জিনিসটা কিন্তু আগে থেকেই হচ্ছিল। করোনার জন্য সবাই লকডাউনে আছে, হয়ত কেউ সিনেমাহলে যেতে পারছে না সেই জন্য মানুষের চোখে লাগছে। গত বছর আমার একটা ছবি ‘অনেকদিনের পরে’ সোজা ZEE5 এ রিলিজ করল।দেবারতির গুপ্তা পরিচালক ছিল। ক্যাট স্টিকস,রনির (সেন) ছবিটাও তো বিশ্বের নানা দেশ ঘুরে সোজা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ করেছে। এটা আগে থেকেই হচ্ছিল হয়ত বড়ো বাজেটের বা বলিউডের বড় ছবি হচ্ছিল না। আমাদের মুশকিল হল আমারা ভাবি বলিউডে যতক্ষণ না কিছু হয়, সেটা ঘটছে না। এখন যেহেতু দুটো-তিনটে বড় বলিউডের ছবি আমাজনে রিলিজ করেছে অমনি সেটা নিয়ে হইচই হচ্ছে। আসলে লোকে ভাবে বলিউডে যা হচ্ছে না সেটা ঘটছে না, আমি নিজেকে দিয়েও সেটা বুঝতে পারি ভালোভাবেই।
ব্যোমকেশ বক্সীর পর আপনাকে সেভাবে জাতীয় প্রেক্ষাপটে দেখা যায়নি, সেই নিয়ে দর্শকদের আক্ষেপ ছিল, পাতাল লোক সেটা দূর করল মন হচ্ছে?
ন্যাশান্যাল অডিয়েন্সের আমাকে নিয়ে কিছু যায় আসত না। তাঁরা আমাকে চিনতই না। কিন্তু বাংলা ছবির দর্শকরা সবসময়ই বলত, বিশেষত প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে আমার যখনই কথা হয়েছে তারা বলেছে তুমি মুম্বইয়ে গিয়ে কেন কাজ করছো না? কেন তোমাকে বলিউডে কাজ করতে দেখা যায় না? আসলে যতক্ষণ না পর্যন্ত তুমি এমন কাজ করছো যে তোমাকে সারা পৃথিবীর লোক নোটিস করছে, সেটা বলিউড না হয়ে বোধহয় উপায় নেই। পরশুদিন প্রসিতকে (রায়) বলছিলাম আমার ২০ বছর লেগে গেল একটা ডলি মেহরাকে খুঁজে পেতে। বলিউড সেটাই করে, কিন্তু বলিউডেও তোমাকে কাজটা সেভাবে পেতে হবে এবং সেইরকম করে পারফর্ম করতে হবে। সারা পৃথিবীর লোক নিজের জায়গা তৈরির চেষ্টা করছে। তা কুড়ি বছর হোক আর তিরিশ বছর, তোমার কাজের দক্ষতাটই এখানে শেষ কথা। না হলে লোকে আজ মাথায় নিয়ে নাচবে,কাল ভুলে যাবে।
আপনি তো তো এখন মুম্বইতেই আছেন?
হ্যাঁ, মেয়ের কাছে এসেছিলাম। লকডাউনে এখানেই আটকে গেলাম। আর কী!
দেখলাম রান্নাবান্না করছেন। ইনস্টাতে পোস্টও চলছে পুরোদমে। ব্যাপারটা কী?
আমি তো একফোঁটাও রান্না করতে পারতাম না। এখানে যখন রান্না শুরু করলাম,উপায় নেই দেখে। যেদিন যা সবজি রান্না করি, বোনকে বলি। বোন (অজপা মুখোপাধ্যায়) হোয়াটসঅ্যাপে লিখে লিখে বা ভয়েস মেসেজে পাঠায়। আমি সেগুলো পড়ে মুখস্থ করে রান্না করছি। আমি তো স্ট্রিক্টলি বলে দিয়েছি আমাকে ওই আন্দাজ মতো, স্বাদ অনুযায়ী নুন,ঝাল দিয়ে দিবি, এইসব লিখবি না। আমার কোনও আন্দাজ নেই এই ক্ষেত্রে। আমি তো রোজভাবি আমার মা ওপর থেকে নেমে আসবে…এই শকটা মা দিতে পারবে না আমি রান্না করছি। আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি থলে হাতে আমি বাজার করতে যাব। কিন্তু করছি। সৌজন্যে করোনা। সবাইকে মাটিতে এনে ফেলেছে।
সবশেষে মেয়ে কী বলল পাতাল লোক দেখে?
অন্বেষা বলল মা ওদের উচিত ছিল তোমার স্বামীকে (নীরজ কবি) মেরে ফেলা। তোমার বোকামির জন্য লোকটা বেঁচে গেল। এটা ওর বক্তব্য। আর একটা কথা, ওর খুব রাগ হয়েছে কেন সাবিত্রীর (পাতাল লোকে ডলির প্রিয় সারমেয়) ছানাগুলোকে কেন শ্যুটিংয়ের পর বাড়ি নিয়ে আসিনি। নিয় এসে থাকলে আমার অন্য ছানা গুলোর সঙ্গে ওরাও একসঙ্গে থাকতে পারত। এটা ওর একটা বড় আক্ষেপ। আসলে ওর সবকিছুর টার্গেট মা। আজ বৃষ্টি হচ্ছে মায়ের দোষ, কাল কেন বৃষ্টি হয়নি সেটাও মায়েরই দোষ। অন্বেষা খুব এনজয় করেছে পাতাল লোক। আসলে ডার্ক থ্রিলার হলেও স্ক্রিপ্ট জুরে একটা সেন্স অফ হিউমার রয়েছে। এখন তো বড় হয়ে গেছে তাই মা-মেয়ে একসঙ্গে বসেই দেখতে পারলাম। ক'বছর আগে হলে সে সুযোগ ছিল না। আর কি!।