স্বস্তিকা মানেই ‘আনকাট’। যা জানাবেন স্পষ্ট জানাবেন, রেখে ঢেকে কথা বলাটা তাঁর ধাতে নেই! নতুন বছরের শুরুতেই ‘বিজয়ার পরে’ নিয়ে হাজির হচ্ছেন নায়িকা। সদ্য অনুষ্ঠিত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে হয়ে গিয়েছে ছবির প্রিমিয়ার। ‘বিজয়ার পরে’ মুক্তির আগে হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে একান্ত আড্ডায় ধরা দিলেন অভিনেত্রী।
শুরুতেই আপনাকে নিউ ইয়ার-এর শুভেচ্ছা। ২০২৩ কেমন কাটলো স্বস্তিকার?
স্বস্তিকা: ২০২৩-এ বেশ কিছু ভালো কাজ করলাম, সেটা বছরের হাই-পয়েন্ট। আমার মেয়ে (অন্বেষা) বাইরে থাকে, ২০২৩-এ সে দু-বার কলকাতায় এসেছিল। সেটা উপরি পাওনা। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে আমার দুটো ছবি প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছিল। শারীরিক দিক থেকে একটা.. আমার সার্জারি হয়েছে। সেটা একটা মাইলস্টোন। আমার মনে হয়, চল্লিশোর্ধ মহিলাদের ইউটেরাস-ওভারি, গাইনোকলজিক্যাল ইস্যু একটা বড় জায়গা নিয়ে থাকে জীবনে। মেনোপজের সময়। এই সময় শরীরে-মনে-মাথায় অনেক চেঞ্জেস হয়। বাকি যেমন জীবন চলার চলছে। আর এটা তো না বললেই নয়। এই বছরে আমি একটা হিন্দি ছবিতে মিস্টার অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করেছি। সেটা আমার জীবনের বিরাট হাইলাইট।
গত বছর নিয়ে কোনও বিশেষ আক্ষেপ? কিছু উপলব্ধি?
স্বস্তিকা: আমি প্রচুর এনজিও-দের সঙ্গে কাজ করি। যারা পথকুকুরদের, বিড়ালদের নিয়ে কাজ করে। অন্য অনেক জন্তু-জানোয়ারদের রেসকিউ করে, তাদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছি। আক্ষেপ একটাই যে সকল জন্তু-জানোয়ারদের তো বাঁচানো যায় না! সাহায্য করতে চেয়েও কখনও কখনও সময়মতো কাজটা করা সম্ভব হয় না। সেটাই আক্ষেপ, যদি ওদের বাঁচাতে পারতাম। আরেকটা আক্ষেপ…(খানিক থেমে)
গাজায় মাসের পর মাস ধরে যুদ্ধ চলছে। এত মানুষ মারা যাচ্ছে, এত শিশু প্রাণ হারিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখে পড়ছে। তাদের জন্য কিছু করা যাচ্ছে না। শুধু বার্তাটা পৌঁছে দিতে পারি যে- আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত, জানা উচিত আশেপাশের দেশ-দুনিয়াতে কী ঘটছে। কিন্তু কিছু করা তো যায় না। সেই আক্ষেপ সারাক্ষণ মাথায় কাজ করে।
আরও পড়ুন-'ওঁকে দেখলে আমার বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ে', কার কথা বলছেন স্বস্তিকা!
‘পিয়া তো অনুপমের দ্বিতীয় বউ, কই ওকে তো টার্গেট করা হল না', সরব স্বস্তিকা
বিতর্কিত বিষয় তারকারা এড়িয়ে যায় সেখানে স্বস্তিকা গাজা-ইজরায়েল নিয়ে কথা বলতে ছাড়েন না। ট্রোলিংয়ের ভয় করে না?
স্বস্তিকা: কেন পোস্ট করব না বলুন তো? যেখানে এত মানুষ মারা যাচ্ছে! আমি গাজার সমর্থনেও কথা বলেছি। ইজরায়েলের হয়েও কথা বলেছি। কিন্তু শিক্ষিত হয়ে, প্রতিবেদন পড়ে… গোটা পৃথিবীর মানুষ যেখানে গাজার সমর্থনে কথা বলছে। সেখানে ইউনাইটেড নেশন থেকে একটা সিজফায়ার ভিটো হচ্ছে না! (বিস্ময়) যে অন্যায়গুলো হচ্ছে সেটা নিয়ে তো কথা বলবই। কী বলুন তো, বিতর্ক শব্দটা আমরা আসলে খুব ক্যাজুয়ালি ব্যবহার করি।
কারুর সঙ্গে প্রেম হয়েছে সেটাও বিতর্ক। প্রেম টিকলো না সেটাও বিতর্ক। কেউ একবারের বেশি দু-বার বিয়ে করছে সেটাও বিতর্ক, কাকে বিয়ে করছে সেটা নিয়েও বিতর্ক… বিয়ে টিকলো না সেটাও বিতর্ক। যুদ্ধ নিয়ে কথা বললেও বিতর্ক.. কোভিডের সময় সোনাগাছির রেড লাইট এলাকার মানুষদের নিয়ে পোস্ট করছিলাম, সেটা নিয়েও বিতর্ক! জীবনে সবকিছু নিয়ে তো বিতর্ক হতে পারে না। আমি কাউকে খুন করলাম, কাউকে রেপ করলাম- সেগুলো নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
দৈনন্দিন জীবনের যে ঘটনা সবার সঙ্গে ঘটে সেটার সঙ্গে বিতর্ক শব্দটা জোড়া উচিত নয়। সেলিব্রিটি ছাড়া দেশে কি কারুর বিয়ে ভাঙছে না? না প্রেম ভাঙছে না। একদিন কোর্টে গিয়ে দেখুন না, কত হাজার হাজার ডিভোর্স কেস চলছে আমাদের দেশে। সেই সব হাজার হাজার ডিভোর্স কেস কি শুধুই সেলিব্রিটিদের? আম জনতার বিয়ে ভাঙছে না? কেউ কি সারাজীবন একজনের সঙ্গেই কাটাচ্ছে? বিতর্ক শব্দটা লিখলে একটু বেশি করে নজরে পড়ে লোকজনের। তাই সেটা লিখে দেওয়া হয়। এগুলো আসলে কিন্তু বিতর্কের আওতায় পড়ে না।
বিতর্ক আর বিস্ফোরক শব্দ তো স্বস্তিকাতে ঘিরে রয়েছে…
স্বস্তিকা: আমি যদি গাজা নিয়ে কথা বলি, সেটা নিয়ে কাগজে কেউ লিখল- ‘গাজা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন স্বস্তিকা’। এটা কি বিস্ফোরক? বিস্ফোরণ তো সত্যি সেখানে হচ্ছে। নিজের সুবিধার জন্য কাগজের লোকজন ওইসব বিস্ফোরক, বিতর্ক শব্দগুলো জুড়ে দেয়। আমার বলা কথাগুলো খুব সাধারণ। আমি অসাধারণ কোনও কথা বলি না বিশ্বাস করুন।
তারকাদের বিয়ে ভাঙা হোক ব্যক্তিগত জীবন, নিয়ে লোকজনের আগ্রহ আছে বলেই তো সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হয়
স্বস্তিকা: সংবাদমাধ্যম কীভাবে বিষয়টাকে তুলে ধরছে সেটাও ভেবে দেখা জরুরি। সংবাদকর্মীদের একটা বড় দায়িত্ব থাকে আম জনতার সামনে কোনও খবরকে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আর আমি তো মনে করি, পাবলিক ফিগাররা জনগণের বাবার সম্পত্তি। আমাদের নিয়ে যখন খুশি যা ইচ্ছে বলাই যায়। আমি এটা অনেকদিন আগেই মেনে নিয়েছি। এটা নিয়ে আর মাথাব্য়াথা নেই। ৪০-এর উর্ধ্বে বয়স মানে, অর্ধেক জীবন তুমি বেঁচে ফেলেছো। লোক আমাকে নিয়ে কী বলল, কী লিখল সেটা নিয়ে যদি পড়ি থাকি তাহলে বাঁচব কখন?
আরেকটা জিনিস না বললেই নয়, পাবলিক ফিগার যদি ছেলে হয় আর সে দু-বার বিয়ে করে তাহলে করে তাহলে কারুর মাথাব্যাথা হয়। কিন্তু একটা মেয়ে যদি দু-বার বিয়ে করে, সে যদি পাবলিক জায়গার মধ্যে চলে আসে। তাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয়। এটা আমাদের সমাজের নিয়ম। আমার জীবদ্দশায় তো এটা পাল্টাবে বলে মনে হয় না।
এবার একটু ছবির কথায় আসি, নতুন পরিচালক অভিজিৎ দাসের ‘বিজয়ার পরে’ ছবির জন্য কেন হ্যাঁ বললেন?
স্বস্তিকা: এই ছবিতে আমার চরিত্রের নাম মৃন্ময়ী। বাবা-মা আদর করে ডাকে মিনু বলে। মৃন্ময়ী নামটা আমার খুব পছন্দের। গল্পটা খুব ভালো লেগেছিল। এই ছবিতে দীপঙ্কর জেঠু, মমতা শঙ্করের সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়েছে। দীপঙ্কর জেঠুকে দেখলেই আমার বাবার কথা মনে হয়। ওই জেনারেশনের অভিনেতারা খুব কম, বেশিরভাগজনই তো চলে গেছেন। এঁনারা এত অন্তর থেকে কাজ করেন, আমি যদি ওঁনাদের মতো একটুও অভিনয় করতে পারি, নিজেকে ধন্য মনে করব।
চরিত্রটা অন্যরকম, চারিদিকে অনেক গোয়েন্দা, ক্রাইম-থ্রিলার দেখছি। এটা সমাজিক ছবি, পরিবারের গল্প। সেই নিয়ে আজকাল ছবি কমই হচ্ছে। আমি যে কাজগুলো করেছি তার থেকে একদম আলাদা। ছবিটা দেখলে মানুষ বুঝবেন, আমার চরিত্রটা অনেকটা অন্যরকম।
বাবা-মেয়ের জটিল সম্পর্কের আবর্ত ঘিরে রয়েছে ‘বিজয়ার পরে’। শ্য়ুটিংয়ের সময় বাবার কথা কতটা মনে পড়েছে?
প্রতিদিন মনে পড়েছে, সবসময়। দীপঙ্কর জেঠু আমাকে ডাকনাম ধরেই ডাকেন। ওঁনারা তো স্বস্তিকা ডাকে অভ্যস্ত নন। মনে হত বাবাই ডাকছে। ভাবতাম, বাবা হেঁটে চলে গেল। সেই মায়ার জায়গা তো আছেই এঁনাদের সঙ্গে কাজ করার। ছোট থেকেই তো এঁনাদের দেখেই বড় হয়েছি। কিফেও যখন স্ক্রিনিংয়ের দিন দীপঙ্কর জেঠু এলেন, মনে হল বাবা এসেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়- সব বাবা-মা'ই বয়স হলে একরকম দেখতে হয়ে যায়। আমার তো বাবা-মা দুজনেই নেই! এঁদের সঙ্গে যতটা সময় কাটানো যায়।
সন্তানদের ঘরে ফেরার গল্প- ‘বিজয়ার পরে’। আপনার মেয়েও তো বিদেশে থাকে। অন্বেষাকে কতটা মিস করেন?
স্বস্তিকা: আমি একদম ভাবি না। ভাবলেই মন খারাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আমি যেহেতু একাই থাকি তখন একাকীত্ব গ্রাস করে আসে। ২০২২ সালে ও প্রথম বাইরে যাওয়ার পর আমার খুব অসুবিধা হয়েছিল। মনকষ্টে কেটেছে। আমি একদম একা থাকতে পারতাম না। কারণ সারাজীবন বাবা-মা'র সঙ্গেই আমার কেটেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর কোভিড এল। তখন মেয়ের সঙ্গেই ছিলাম। একা থাকার অভ্যেসটা করতে হয়েছে। এখন আর খুব একটা অসুবিধা হয় না। আমি মনোবিদের কাছে গিয়েছি, আমি থেরাপি নিয়েছি। আমি একা থাকার বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পারছিলাম না। এখন ভালো আছি। এখন একা থাকতে ভালো লাগে। দেড় বছর আগে অনেক স্ট্রাগল করেছি, এখন ম্য়ানেজ করে ফেলেছি।
মায়ের মতো স্পষ্টবাদী অন্বেষা। মেয়েকে বোঝান কিংবা সর্তক করেন?
স্বস্তিকা: একদম নয়। উলটে বলব, আমার মধ্যে যে সত্ত্বা রয়েছে ওর মধ্যে সেগুলো আরও বেশি করে থাকা উচিত। পৃথিবী যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে নিজের মতো করে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়াটা জরুরি। আমি ওর বয়সে ওতো গুছানো ছিলাম না। সময় এগিয়েছে, অনেক বদল এসেছে। নিজের যা ঠিক মনে হবে সেটা করাটা জরুরি। তাছাড়া মায়ের সব বারণ শোনবার বয়সও ওর নেই।
নিন্দকরা বলছেন স্বস্তিকা আজকাল বড্ড চুজি, খুব বেছে কাজ করছেন?
স্বস্তিকা: আমি তো সবসময়ই বেছে কাজ করি। নতুন করে তো বেছে কাজ করছি না। শিল্পীর কাছে কোয়ালিটি কাজটা জরুরি। আমি স্টার নই, সেলেব নই- শিল্পী। তাই আমার শিল্পসত্ত্বা যে কাজে সমৃদ্ধ হবে আমি সেই কাজ করব। সেখানে ভাষা কোনও বাধা নয়। টলিউড হোক, বলিউড হোক বা পঞ্জাবি হোক কিংবা তেলুগু ইন্ডাস্ট্রি হোক আমি কাজের জন্য তৈরি। আমি মরাঠি ভাষায় কাজ করেছি। আশা করব ২০২৪-এ আরও অন্য ভাষায় কাজ করব। ওটিটির সুবাদে আমরা সবভাষার কাজ দেখছি। নিজেকে একটা ভাষায় আটকে রাখব কেন?
২০২৪-এ ফের সৃজিত-স্বস্তিকার রিইউনিয়ন, টেক্কা আসছে। কী বলবেন?
স্বস্তিকা: একজন দক্ষ পরিচালক। দেব টলিউডের সুপারস্টার। আমি নিশ্চিত দুর্দান্ত কিছু একটা হবে। দেবের সঙ্গে ফটোশ্যুট করেছি, কিন্তু ২৩ বছরের কেরিয়ারে প্রথমবার দেবের সঙ্গে কাজ করছি। একটা ভালোলাগা, উত্তেজনা- সবটাই রয়েছে।
প্রাক্তন সৃজিতের ছবিতে ফের স্বস্তিকা। এই বিষয়টা কীভাবে দেখেন?
স্বস্তিকা: কিছুভাবেই দেখি না। আমাদের বন্ধু-বান্ধবরা আলোচনা করি, ‘বিয়ের পাঁচ বছর পরেই স্বামী-স্ত্রী ভাই-বোন হয়ে যায়’। সৃজিত আমার প্রাক্তন ছিল, ১০ বছর আগে। তাহলে এতদিনে আমরা কী হতে পারি? স্বামী-স্ত্রী যেখানে ভাইবোন হয়ে যায়। ১০ বছর আগের সম্পর্ককে প্রাক্তন তো বলা যায় না! আমার সাথে খুবই সখ্য রয়েছে। ইভেন্টে যাই, কথাবার্তা হয়। হতে পারে ২০২৪-এ আমি সৃজিতের সাথে আরকেটা ছবি করলাম। ১০ বছরে মানুষ মারা গেলে তাদের আরেক জন্ম হয়ে যায়। প্রাক্তন শব্দটা তো মাথায় বা মনে, আসার মতো জায়গাটাই আর নেই।
নতুন আর কী প্রোজেক্ট আসছে?
স্বস্তিকা: নিখোঁজ ২ আসবে। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে আমার প্রথম কাজ এই বছরই সকলে দেখবে, খুব এক্সাইটেড ওটা নিয়ে। অনেকগুলো ভালো ভালো কাজের কথা হচ্ছে। দেখা যাক, এই তো বছর শুরু হল। অনেক ভালো কাজ করব। সেটাই জীবনের প্রায়োরিটি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাই মনে হচ্ছে, সময় কমে আসছে। ৪০ হয়ে গেলে সবার মধ্যেই এই তাড়াটা কাজ করতে হবে।
২০২৪-এ কোনও রেজোলিউশন?
স্বস্তিকা: নতুন বছরের রেজোলিউশন একটাই। আমি ফার্মলি চেষ্টা করছি সিগারেট খাওয়াটা যেন ছেড়ে দিতে পারি। নিজের জন্য, নিজের স্বাস্থ্যের জন্য সিগারেট খাওয়াটা ছেড়ে দিতে চাই। ওই কম কম খেয়ে ছেড়ে দেব এমনটা নয়। ওটা জাস্ট হয় না। একদিন সকালে উঠে সিগারেট খাওয়াটা জাস্ট বন্ধ করে দিতে হবে।