হইচইতে সদলবলে চলে এসেছেন ফেলুদা। এবার তাঁদের অভিযান কাশ্মীরে, থুড়ি ভয়ঙ্কর ভূস্বর্গে। একদিকে যখন দর্শকদের মনে ধীরে ধীরে জায়গা বানাচ্ছে ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর, ভিউজের সঙ্গে বাড়ছে প্রশংসাও তখন এই সিরিজের শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে নানা গল্প শোনালেন ফেলু ত্রয়ীর তোপসে। ওরফে কল্পন মিত্র। শুনল হিন্দুস্তান টাইমস।
সিরিজ তো মুক্তি পেয়ে গেল, প্রিমিয়ারও সারা। কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন দর্শকদের থেকে?
কল্পন: আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবরা তো বলছে সবার ভালো লেগেছে। আমাদের যে কটা বানানো হয়েছে তার মধ্যে এটাই সবথেকে গ্র্যান্ড স্কেলে বানানো ফেলুদা। শীত পড়েছে, সেই সময় কাশ্মীরের বরফ দেখতে পাচ্ছেন সবাই, সেটা একটা উপরি পাওনা দর্শকদের কাছে। প্রিমিয়ারে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরাও জানিয়েছেন যে ভালো লেগেছে। ফেসবুকেও যা দেখছি ভালো রেসপন্স পাচ্ছি।
আরও পড়ুন: কমছে বাংলা ছবির সংখ্যা, অনির্বাণ বললেন, 'হয়তো এমন ছবি করতে পারছি না যেটা হলে দর্শকদের হলে টানবে'
তোপসে হওয়ার সুযোগটা এল কীভাবে?
কল্পন: সেই সময় অডিশন নেওয়া হচ্ছিল, আমিও ওখানে যাই। অডিশন দিই। আর তাছাড়া আমি তখন ব্রিটানিয়ার একটা অ্যাড করেছিলাম। সেটাতে আবিরদা আর আমি ছিলাম। ওখানে ওভাবে ফেলুদা তোপসে বলা ছিল না ঠিকই, কিন্তু দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল ব্যাপারটা। তো সেটা সৃজিতদার কাছে একটা রেফারেন্স ছিল। আর, উনি আমায় বারবার বলেছিলেন যে আমার মুখের কাটিংটার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের আঁকার সঙ্গে মিল আছে। তো সেটাও একটা স্ট্রং ব্যাপার ছিল আমায় কাস্ট করার।
কাশ্মীরে শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতার গল্প শুনি একটু।
কল্পন: কোথা দিয়ে শুরু করি! (হাসি) আমি যেদিন প্রথম কাশ্মীরে ঢুকেছিলাম সেদিন রাস্তায় প্রচণ্ড বৃষ্টি নামে। আমাদের সবার আগে সোনমার্গে যাওয়ার কথা ছিল। বৃষ্টির কারণে আমাদের সেখানে পৌছতে গিয়ে ৪-৫ ঘণ্টা দেরি হয়ে যায়। তারপর স্নোফল হওয়ায় রাস্তা পুরো বরফে ঢেকে গিয়েছিল। আমার জীবনের প্রথম স্নোফল ছিল ওটা। এত বরফ পড়েছিল যে গাড়ি এগোতেই পারছিল না। মানে ওই বরফ না কাটা অবধি গাড়ি এগোতেই পারবেই না। যে হোটেলে বুকিং ছিল সেখানেও পৌঁছতেই পারিনি। বাধ্য হয়ে অন্য হোটেলে তারপর বুকিং করা হয়। এভাবেই আমার ভূস্বর্গ ভয়ঙ্করের সফর শুরু হয়। তারপর...
বলুন।
কল্পন: প্রথমে একটু ভয় পাচ্ছিলাম, আমি কখনও মাইনাস ১১, মাইনাস ১৫-তে কাজ করিনি। তাই ভাবছিলাম কী হবে। যদিও আমরা সবাই বরফের মধ্যে নেমে পড়েছিলাম। বরফ নিয়ে খেলছিলাম। খুব মজা হয়েছিল। গোটা শ্যুটিংটাই ওই তাপমাত্রায় হয়েছিল।

অত শীতে প্রায় সেই অর্থে শীত পোশাক না পরেই শ্যুটিং। কষ্ট হয়নি?
কল্পন: খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজির কারণে একটা ড্রেস কোড মানার ছিল। তবে শট শেষ হওয়ার পরই গায়ে কিছু চাপিয়ে নিচ্ছিলাম। খালি আমাদের নয়, সবারই খুব কষ্ট হচ্ছিল। যদিও, ওই তাপমাত্রায় যতই জামাকাপড় পরুন, যাই করুন একটা ওই শিরশিরানি ঠান্ডা থেকেই যায়, যেটা সমানে খোঁচা দিচ্ছিল। হাওয়ায় হাত অবশ হয়ে যাচ্ছিল, বরফে পা ঢুকে যাচ্ছিল। হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি নেমে যাচ্ছিল। আর বৃষ্টি যখন গায়ে লাগছিল মনে হচ্ছিল যেন গায়ে পিন ফোটাচ্ছিল। বৃষ্টি তাও একরকম। কিন্তু ওই যে রোদ উঠছিল সেটায় মাথা ধরে যাচ্ছিল। সানগ্লাস ছাড়া তাকানো যাচ্ছিল না। বরফে রোদ লেগে সেটা আরও চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। সানগ্লাস পরে তো আর অভিনয় করা যায় না। ফলে মাথা ধরা, চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার বিষয়টা থেকেই গিয়েছিল আগাগোড়া। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের গল্প এটা, তাই এই প্রতিকূলতাগুলো থ্রিলের মাত্রা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। অভিনয়ে এগুলো অনেকটা সাহায্য করেছিল।
কতক্ষণ শ্যুটিং হতো?
কল্পন: যেদিন ডে লাইটে শ্যুটিং থাকত সেদিন যতক্ষণ আলো থাকত ততক্ষণ অবধি শ্যুটিং হতো। ওই বিকেল ৫-৫.৩০ টা অবধি। আর যেদিন অন্ধকারে শ্যুটিং থাকত সেদিন একটা গ্যাপ দিয়ে আবার রাতে শ্যুটিং হতো ১০-১০.৩০ টা অবধি। কোনও কঠিন সিন থাকলে সেটা ঠিক মতো না হলে বারবার শট নেওয়া হতো যাতে সেটা পারফেক্ট হয়।
আরও পড়ুন: দেবের ছবির ভুলচুক চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন সৃজিত! তবুও কেন বললেন, 'খাদান ভীষণ জরুরি ছবি...'?
সৃজিত দা যে বলেছেন আর ফেলুদা বানাবেন না, কী মত আপনার?
কল্পন: কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়। সব কিছু তো আমাদের হাতে থাকে না। তবে এখন যেহেতু সবে সবেই ফেলুদা মুক্তি পেল, ওখানে যে কাজ করে এসেছি সেটার ফাইনাল প্রোডাক্ট দেখতে পাচ্ছি ফলে সেটা নিয়ে উত্তেজনা অনেক বেশি। আনন্দ বেশি। আবার একই সঙ্গে, অনেক স্মৃতিও তো জড়িয়ে আছে, একসঙ্গে চারটে কাজ করলাম। টিমটাকে মিস করব। যখনই শ্যুটিং হতো, যখনই ফেলুদা হবে জানতে পারতাম, কোথায় যাওয়া হবে সেটাও জানতে পারতাম গোটা বিষয়টা নিয়ে একটা থ্রিল থাকত। তারপর সেখানে গিয়ে নতুন নতুন জায়গা খুঁজে পাওয়া, নতুন নতুন খাবার খাওয়া, বিভিন্ন লোকেশনে শ্যুট করাগুলোকে মিস করব। কিন্তু এখনও বিষয়টা অতটা হিট করেনি। হয়তো আরও কিছুদিন পর গিয়ে ব্যাপারটায় ধাতস্থ হবো। কষ্ট হবে তখন। আপাতত সদ্য মুক্তি পাওয়া কাজ নিয়ে উত্তেজনাটাই বেশি।
যদি ভবিষ্যতে অন্য কোনও পরিচালক আপনাকে তোপসে বানাতে চান?
কল্পন: এখন এগুলোর কথা ভাবছি না। আর যদি কখন এমন কিছু হয়, তাহলে সেখানে খালি আমার সিদ্ধান্ত থাকবে না। এটা একটা টিমের ব্যাপার। আমাদের (কল্পন মিত্র, টোটা রায়চৌধুরী এবং অনির্বাণ চক্রবর্তীর) একটা দারুণ ইকুয়েশন হয়ে গিয়েছে। তো সেটা যদি আসে তখন দেখা যাবে।
ফেলু ত্রয়ীর রসায়ন কেমন?
কল্পন: টোটাদা, আমি আর অনির্বাণদা এত ভালো একটা ইউনিট হয়ে গিয়েছি যে কী বলব। একসঙ্গে চারটে কাজ করলাম। তিনজনই খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছি এখন। একে অন্যের সঙ্গে খুবই কনফোর্টেবল আমরা।

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
কল্পন: সৃজিতদা খুবই স্ট্রিক্ট থাকতেন সেটে। নিজে যেমন ভীষণ প্রফেশনাল, চান সেটের বাকিরাও যেন সেই দারুণ প্রফেশনালিজম মেনে চলেন। প্রথম যখন আমি ফেলুদা করি, তখন ছিন্নমস্তার অভিশাপের সময় আমার কিছু গাফিলতি ছিল। ফোকাসে অসুবিধা হচ্ছিল, নতুন সেটাপে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। তো তার জন্য সৃজিতদা আমায় একটু বকাবকি করেছিলেন। তারপরই নিজের ভুলগুলো বুঝে সেগুলো শুধরে নিই। বকাও শুনতে হয়নি আর পরে। সৃজিতদা অভিনেতাদের অনেকটা জায়গা দেন। বেসিক কিছু নিয়ম, জিনিস সেট করা থাকে, সেগুলো আমরা সবাই জানি। তার বাইরে নিজের মতো এক্সপ্লেন করতে দেন। বলেন, 'দেখ লাইনগুলো আমি এভাবে লিখেছি। কিন্তু তুই তোপসে করছিস। তোর যদি মনে হয় এই লাইনগুলো এভাবে বলা উচিত বা ওখানে অন্য কিছু বলা উচিত তাহলে তুই বলতে পারিস।' কিন্তু উনি এত ভালো স্ক্রিপ্ট লেখেন যে কিছু করতে হয়নি তেমন।
ঋদ্ধির (সেন) সঙ্গে বন্ধুত্ব জমলো?
কল্পন: বাবা রে, সে আর বলতে! ঋদ্ধির সঙ্গে লুক সেটে প্রথম আলাপ হয়। তখনই বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আর যেহেতু আমরা প্রায় সমবয়সী তাই সেটা আরও তাড়াতাড়ি হয়। যদিও ও অনেক বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, অনেক বেশি কাজ করেছে আমার থেকে, কিন্তু কখনই সেটা বুঝতে দেয়নি। খুবই ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। লুক সেটের সময়ই আমরা প্ল্যান করে নিয়েছিলাম যে ওখানে গিয়ে কী করব, কোথায় যাব, কী খাব। চরিত্র নিয়ে কথা বলতাম। খালি ঋদ্ধি নয়, শাওন, অনিরুদ্ধ আমরা সবাই প্রায় একই বয়সী। ফলে সবার সঙ্গেই দারুণ বন্ডিং হয়ে গিয়েছিল। খুব মজা করে কাজ করেছি। শাওনকে যদিও আগে থেকে চিনি, বন্ধুত্ব ছিল।
কল্পনের পছন্দের তোপসে কে?
কল্পন: সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। ওই ত্রয়ীকে কেউ ছাপিয়ে যেতে পারেনি কখনও। ওরা সবার উপরে। এছাড়া শাশ্বতদার করা তোপসেও খুব পছন্দের।
আরও পড়ুন: অমিতাভকে নিয়ে বেফাঁস মৌসুমী! কেন বললেন, 'কষ্ট করেছে, কিন্তু বড় হয়ে ভালো হয়েছে বলব না'?
ফেলুদার স্যাটেলাইট, রহস্যের সঙ্গে আগাগোড়া জড়িত। কিন্তু কল্পন কেমন ধরনের কাজ, ছবি পছন্দ করেন?
কল্পন: আমি নিজেও থ্রিলার দেখা ভীষণ পছন্দ করি। ডিটেকটিভ ফিকশন হলে আরও ভালো। কিন্তু একটা ভালো থ্রিলার সিনেমা বা সিরিজ দেখার পর কেমন খামতি লাগে। মনে হয় আরও একটা এরম কাজ দেখি। কিন্তু চট করে তেমনটা পাওয়া যায় না। খুঁজতে খুঁজতে এক দুই সপ্তাহ পর আবার একটা ভালো কাজ খুঁজে পাই। তখন ওটা দেখি। থ্রিলার আমার কাছে অক্সিজেনের মতো। থ্রিলার আমার দরকার, না হলে থাকতে পারি না।
অভিনয়ে আসা কীভাবে?
কল্পন: স্কুল থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। নাটক করতাম। সেই অর্থে গ্রুপ থিয়েটার করিনি। কিন্তু নাটকে কাজ করেছি কিছু। যদিও বহু বছর থিয়েটার করা হয়নি আমার। এরপর সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি, অভিনয় করেছি, সহকারী পরিচালকের কাজ করেছি, ডকুমেন্টারি শ্যুট, ভয়েসের কাজ, এডিটিং সবই করেছি। আমার প্রথম ফিচার ছবি ক্যাটস্টিকস। রনি সেন পরিচালনা করেছিলেন সেই ছবিটি।
আগামীতে কোন কাজে দেখা যাবে?
কল্পন: সত্যি বলতে, আপাতত এখনই কোনও কাজ নেই।

বড়দিন আর ইংরেজি নববর্ষের কী প্ল্যান?
কল্পন: বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যাব বা, কাছের মানুষদের সঙ্গে সময় কাটাব। বসে গল্প করা বা আনন্দ করা, এসব আর কী!