রঙ্গমঞ্চ থেকে রুপোলি পর্দা, সর্বত্র অবাধ বিচরণ তাঁর। ছোটপর্দাতেও সমান সাবলীল তিনি। টলিগঞ্জের আনাচকানাচ তাঁর চেনা। যে বৃত্তে অর্থ কম সেটাকেই পরিসরকেই আঁকড়ে ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় সাড়ে তিন দশক পার করে ফেলেছেন কৌশিক সেন। বরাবর নিজস্ব রাজনৈতিক ঘরানায় বিশ্বাসী তিনি। ভোট আবহে মন খুলে কথা বললেন হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে।
চারিদিকে ভোট নিয়ে এত চর্চা, আলোচনা। ক্ষমতায় যে সরকারই আসুক না কেন, শিল্পী হিসাবে তথা ভারতীয় হিসাবে আপনি কী ধরণের বদল চাইবেন?
কৌশিক সেন: (হাসি) এটা তথ্য বেরিয়ে গেছে, প্যানডেমিকের পর থেক আমাদের দেশের ১%-২% মানুষের হাতে কী পরিমাণ অর্থ চলে এসেছে। আমাদের দেশে যে বেকার, তাদের মধ্যে ৮০% কম বয়সী বেকার। তাহলে তুমি কী বদল আমি আশা করবে? রামমন্দির বানিয়ে বদল করা যায় না। মানুষ দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারছে চাকরি চাই। আমাদের তৃণমূল সরকার যখন ২ টাকা কিলো চাল দেয়, কিংবা কেন্দ্রে বিজেপি সরকার যখন বলে আমি ৮২ কোটি লোককে ফ্রি-তে রেশন দেব। তখনই বোঝা যাচ্ছে, কত কোটি মানুষ এ দেশে খেতে পায় না। গাজাতে চাকরি করতে চলে যাচ্ছে আমাদের দেশ থেকে, যেখানে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। কতটা অসহায় হলে সেখানে লোকে যাচ্ছে। তাহলে কী বদল চাইব? বরং আমি খুব সোজাসুজিভাবে বলছি, নরেন্দ্র মোদী সরকার (ক্ষমতায়) ফিরে আসলে দেশের সর্বনাশ!
সম্প্রতি আপনাকে দাবাড়ুকে দেখা গেল। সেখানে দেখা গিয়েছে রাষ্ট্র উঠতি ক্রীড়াবিদের পাশে দাঁড়ায় না। বিশ্বাস করেন?
কৌশিক সেন: শুধু খেলার ক্ষেত্রে নয়, আমাদের রাষ্ট্র… ভারতবর্ষের সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার, সত্যি তো কোনও প্রতিভার পাশে দাঁড়ায়নি। এটা আজ বলে নয়, কোনওদিনই হয়নি। আগেও তাই ছিল। এখন তো রাষ্ট্রের দায়িত্বে বিজেপি, আর এখানে তৃণমূল। আগে যখন বাংলায় সিপিএম ছিল বা কেন্দ্রে কংগ্রেস ছিল তখনও ছবিটা আলাদা ছিল না। স্পোর্টস হোক বা শিল্পী, তাঁদের নামডাক হয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্র ক্রেডিট দিয়েছে। আর এখনকার কথা তো ছেড়েই দাও, অলিম্পিকে পদকজয়ী কুস্তিগীরদের ওইভাবে হেনস্থা করেছে বিজেপি সরকার, সুতরাং বর্তমান রাষ্ট্রের দায়িত্বে যে সরকার রয়েছে, তাঁরা ভয়াবহ। তাদের কাছে কিছু আশা রাখাটাই অন্যায়।
শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ব্যানারে কাজের কেমন অভিজ্ঞতা?
কৌশিক সেন: যে কোনও ছবির জন্য ওরা একটা স্টাডি করে। ওদের ছবির বিষয় নির্বাচনের মধ্য়ে সোসিও-পলিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। ওদের সব ছবি আমার পছন্দের তা নয়, তবে সাবজেক্টগুলো বড্ড ভালো বাছেন। এই ছবিতেও তাই। পথিকৃতের মতো একটা ইয়াং ছেলে খুব ভালো কাজ করল। সূর্যশেখরের জীবনের অনুপ্রেরণায় এই ছবি। দাবা খেলা তো রয়েইছে, এর পাশাপাশি একটা মানুষের জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাত এই ছবিতে ধরা পড়েছে। আমি কোনও ফিকশন্যাল চরিত্রে এখানে অভিনয় করিনি, এই চরিত্রটা সূর্যশেখরের জীবনে এসেছিল।
ঋদ্ধি বরাবর সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদী সরকারের বিরোধিতায় তৎপর থাকে। এটা নিয়ে কটাক্ষের মুখেও পড়তে হয়। কখনও বাবা হিসাবে ওকে সচেতন করেছেন?
কৌশিক সেন: সোশ্যাল-পলিটিক্যাল সচেতনতাবোধটা ঋদ্ধির মধ্যে খুব ছোট থেকে তৈরি হয়েছে, সেটা কিন্তু তৈরি করেছে ওর মা (রেশমি সেন)। রেশমির অবদান সবচেয়ে বেশি, তারপর অবশ্য়ই ও আমাকে দেখেছে। সর্বোপরি ঋদ্ধি নিজে খুব বুদ্ধিমান ছেলে। একটা বয়স অবধি ছেলেমেয়েকে গাইড করা যায়, তারপর তার ভাবনাচিন্তা, তার মতামত সে নিজেই তৈরি করে। ফলে আমার এবং রেশমির যেটুকু গাইডেন্স, তারপর ও নিজে পড়াশোনা করে, নিজে চর্চা করে ও নিজের বিবেচনাবোধ তৈরি করেছে, শুধু একজন মানুষ হিসাবে নয় একজন শিল্পী হিসাবেও বটে। এটা নিয়ে আমাদের কোনও দুশ্চিন্তা নেই। ঋদ্ধি ম্যাচিউর ছেলে।
আপনি তো একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। এর জন্য কখন কাজ পেতে অসুবিধা হয়েছে?
কৌশিক সেন: না, এখনও পর্যন্ত টাচউড আমার কাজ পেতে কখনও অসুবিধা হয়নি। তবে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টি এলে কী হবে আমি জানি না। এরা তো মানুষের খাওয়া-দাওয়াও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়! কী খাব, কী খাব না… এরা বাংলায় ক্ষমতায় আসলে সত্যি জানি না…তৃণমূল সরকার প্রচুর চুরি-চামারি করছে। সেটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বলতেও দ্বিধা নেই। কিন্তু এদের মধ্যে শিল্পীদের সম্পর্কে ভয়-মিশ্রিত একটা শ্রদ্ধা রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় এখনও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায় এইসব সিনিয়র মানুষদের সম্মান করেন।
বামফ্রন্টের একটা কালচারাল উইং ছিল, গণনাট্য সংঘ বলো … সারা বিশ্বের যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সেটা নিয়ে বামেদের একটা চর্চা আছে, একটা মতামত আছে। সে জায়গায় তৃণমূল ডিসঅর্গানাইজড একটা ফোর্স। কিন্তু পুরোনো কংগ্রেস থেকে ভেঙে আসা দল তো, তাই শিল্পীদের প্রতি ওদের একটা সম্মান আছে। তবে বিজেপি সেই সম্মান দিতে জানে না। ওঁরা তাঁবেদারি চাই। তাই হয়ত কঙ্গনা রানাওয়াত বলতে পারেন নরেন্দ্র মোদী বিষ্ণুর অবতার। ওরা সম্পূর্ণ আনুগত্য চায়। তাই বিজেপি এখানে ক্ষমতায় এলে কী হবে জানি না। আমি তৃণমূলের প্রচুর বিরোধিতা করেছি বা বামেদেরও বিরোধিতা করেছি তাতে আমার কেরিয়ারের কোনও ক্ষতি হয়নি। হয়ত তলে তলে হয়েছে, আমি জানি না।
বাংলা ছবির মান পড়ে যাওয়া নিয়ে এত আলোচনা। ‘ঘটিয়া’ তকমাও মিলেছে। তার মধ্যেও কনটেন্ট নির্ভর ছবি কিন্তু ভালো ফল করছে। তালিকায় রয়েছে আপনার অর্ধাঙ্গিনী।
কৌশিক সেন: অর্ধাঙ্গিনীর মতো ছবি বক্স অফিসে চলাটা খুব সিগনিফিকেন্ট। আসলে ব্য়বসাটা না হলে দিনের শেষে চলবে না। আমরা চাইব কনটেন্টও ভালো হোক আবার ব্যাবসাটাও ভালো হোক। আসলে মানুষের দৈনন্দিন বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, সেখানে মানুষ অনেক সময় কনফিউসড হয়ে যান কী দেখব। সেই জায়গায় দাবাড়ু চমৎকার একটা বিষয় নিয়ে তৈরি। এটা দেখে কেউ কমপ্লেন করেনি যে আবার একটা থ্রিলার, আবার একটা ফেলুদা আবরা একটা ব্যোমকেশ। অনেকেই আফসোস করেন কেন অন্যরকমের কাজ হচ্ছে না।
আমি সম্প্রতি অতি উত্তম দেখেছি। এটা সৃজিতের সবচেয়ে ভালো কাজ এমনটা নয়, তবে এর মধ্যে একটা আলাদা মজা আছে, অন্যরকম একটা প্রয়াস। সবটা সাক্সেসফুল হয় তা নয়, ভিন্ন কিছু করার একটা বার্তা ছিল অতি উত্তম-এ। হচ্ছে ভালো কাজ। ঘটিয়া শব্দটা নিয়ে অভিমান করে লাভ নেই। এটাকে ইতিবাচক সমালোচনা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, সেটাই কাম্য।