পাঁচ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলল। বিনোদিনী একটি নটীর উপাখ্যান মুক্তি পাওয়ার আগে ছবি বানানো-লড়াইয়ের গল্প থেকে নায়িকা, বাংলা ছবির বর্তমান অবস্থা নিয়ে হিন্দুস্থান টাইমস বাংলাকে কী জানালেন পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায়?
কেমন আছেন?
রামকমল: এই রে, এটা এখন ঠিক বলতে পারব না।
কেন টেনশন হচ্ছে?
রামকমল: টেনশন হচ্ছে না। উত্তেজনা কাজ করছে একটা। বহু প্রতীক্ষার পর আমাদের সবার স্বপ্ন কোথাও গিয়ে প্রতিফলিত হতে চলেছে। আমাদের গোটা টিমের ৫ বছরের একটা সফর তো... সেই জন্যই একটা উত্তেজনা কাজ করছে। যাঁদের জন্য সিনেমাটা বানানো, মানে এই পুরো কষ্টটা তো দর্শকদের জন্যই করা, তাঁদের যেন এটা ভালো লাগে। তাঁরা যেন এটাকে গ্রহণ করেন এটাই এখন আমার একমাত্র চাওয়া এখন।
প্রযোজক নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল বলেছেন। লড়াইটা কেমন ছিল?
রামকমল: আমরা যে সময়টার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম সেই সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল। ২০১৯-এ ছবিটা ঘোষণা করা হয়। ২০-২১ তো লকডাউন ছিল। সেই সময় সবাই OTT-কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিল। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তো যাঁরা এসেছিলেন সিনেমাটা করবে বলে তাঁরা বললেন এখন তো কেউ সিনেমা হলে যাবে না। তাহলে এইরকম ভাবে বানানো কেন? বলা হল ‘ছোট বাজেটের ঘরোয়া ফ্যামিলি ড্রামা করো, থ্রিলার করো’। বায়োপিক করতে না করা হল, তার উপর আবার মহিলাকেন্দ্রিক ছবি যেখানে তথাকথিত কোনও বক্স অফিস হিরো নেই। এই জিনিসগুলোর সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। যাঁরা রাজি হয়েছিলেন তাঁরা পিছিয়ে যান।
রুক্মিণী মৈত্রকেই কেন বিনোদিনী হিসেবে ভেবেছিলেন?
রামকমল: আমার মনে হয়েছিল ওর মধ্যে সেই ব্যাপারটা আছে। সেই স্মার্টনেস আছে। চরিত্রটা বুঝতে পারবে বলে মনে হয়েছিল। রুক্মিণীর মধ্যে সেই ব্যাপারটা আমি দেখতে পেয়েছিলাম। রুক্মিণীর সঙ্গে আমার আলাপ, বন্ডিং অনেক পুরনো, প্রায় ২০১৭ বা তার আগে। তখনও ও সিনেমায় আসেনি, NT ১ স্টুডিওয় শ্যুটিং করছিল চ্যাম্পের। তখন আমরা অনেক গল্পের বই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, কবিতা, ফ্যাশন, মিউজিক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমি তখনই বুঝেছিলাম যে ও বুদ্ধিদীপ্ত ভীষণ। সিনেমা করছে মানে তার বাইরে কিছু জানে না, গল্পের বই পড়ে না, পড়াশোনা করে না, বা সারাক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় আছে ওরম না। ও আলাদা বাকিদের থেকে। আর এই বন্ডিং তৈরি হওয়ার পর যখন আমি ভাবলাম যে বাংলায় আমি বিনোদিনী বানাব তখন ওর কথায় মাথায় এল।
ট্রেলার থেকে গান কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
রামকমল: রেসপন্স ভীষণ ভালো পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে যে বাঙালিরা বোধহয় আশা করছে যে এটা একটা অন্যধরনের ছবি হতে চলেছে। এটার ভিজ্যুয়াল, ট্রিটমেন্ট আলাদা হবে বলে তাঁরা বিশ্বাস করছেন। তো আমরাও যেটা চেষ্টা করেছি সেটা এবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে কী হবে না সেটা দর্শকরা বলবেন।
আশুতোষ গোয়ারিকরের সঙ্গে দেখা করলেন রুক্মিণী, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকেও ডাক পেলেন বিনোদিনীর জন্য। আপনাদের হাত ধরে বাংলা ছবি এক নতুন উচ্চতায় গেল, কেমন লাগছে?
রামকমল: প্যান ইন্ডিয়া ফিল্ম বলে তামিল, তেলুগু, মালায়লাম সহ সব ছবি উদযাপন করছি যেটা খুব ভালো জিনিস। করা উচিতও। তেমন ভাবেই আমি চাই বাংলা ছবিটাকেও উদযাপন করতে। বাংলা ছবি কেন পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডির মধ্যে শেষ হবে? আমাদের কাছে এত সাহিত্য আছে, গান আছে, গল্প আছে, অভিনেতা, অভিনেত্রী আছে তাহলে কেন নয়? আমাদের থেকে তো শিল্পী, ট্যালেন্ট নিয়ে গিয়ে ওরা জাতীয় স্তরে ব্যবহার করে। আমাদের প্রতিভা যখন আমাদের শহরেই আছে, তাহলে আমরা কেন আমাদের বাংলা ছবি করার সময় কার্পণ্য করি? এটার উত্তর আমি পাইনি। কার্পণ্যতাটা আমি দূর করতে চেয়েছি। আর তাতে আমার সহযোগী হয়েছে প্রমোদ ফিল্মস এবং দেব এন্টারটেইনমেন্ট ভেঞ্চার্স লিমিটেড। এই দুই প্রযোজক না থাকলে হতো না। আর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় বিনোদিনীর সম্মান পাওয়ার বিষয় বলি, উনি তো নাট্যসম্রাজ্ঞী ছিলেন। তো ওখান দিয়ে যখন আমাদের ডাকল, সম্মান দিলেন ওঁরা তখন কিন্তু মনে হল আমরা সবাই কোথাও গিয়ে এক। সিনেমা, নাটক, যাত্রা, বইমেলা, গান, বাউলগীতি সবই তো এক ছাদের তলায়। রামকৃষ্ণ বলে গেছিলেন 'এতে লোকশিক্ষে হবে।' আমরা তো লোক শিক্ষা দিই। বই পড়ার সঙ্গে গান, নাটক, সিনেমা সবেই তো লোক শিক্ষা হয়। 'মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে হয় যদি, কিছু বলতে হয় যদি তাহলে স্টেজ, অভিনয়ের মাধ্যম দিয়ে বলো', উনি তো বলেই গেছেন। সেটাই কোথাও গিয়ে এত বছর পর এক হল, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা একটা সিনেমাকে সেই সম্মান দিল।
আরও পড়ুন: ঢেউয়ে চেয়ার উল্টে গেছিল, সেটা তোলার পর দেখা গেল তার নিচে কাঞ্চনদা: সুহোত্র
আপনাদের লড়াইয়ের ফসল, স্টার থিয়েটারের নাম বদলে আজ সেটা বিনোদিনী থিয়েটার।
রামকমল: এটার ক্রেডিট আমি নিতে চাই না। আমি এটার অধিকারী নই। আসল যুদ্ধটা কিন্তু রুক্মিণী লড়েছে। ও একদিন ভোরবেলা দিদিকে (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে) একটা পাঁচ পাতার মেসেজ পাঠিয়েছিল। সেটার সাক্ষী আমি ছিলাম, আর কেউ না। লুকিয়ে সাক্ষী আর কী! (হাসি) কিন্তু ব্যাপার রাতারাতি হয়নি, মানুষ যেমনটা ভাবছে। উনি সবটা দেখে বুঝে, ধাপে ধাপেই করেছেন যা করার। আমি খুব কৃতজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যে উনি এটা করেছেন। আমার অবদান বলতে আমি যখন থেকে এই ছবি নিয়ে কাজ শুরু করেছি তখন থেকে ভেবেছি স্টার থিয়েটারের নাম যেন বি থিয়েটার বা বিনোদিনী থিয়েটার হয়ে যায়। উনি (নটী বিনোদিনী) তো এই একটাই জিনিস চেয়েছিলেন, ওঁর নামে একটা থিয়েটার। আমাদের দেশ স্বাধীন হল, নাট্য আন্দোলন হল, এত সরকার এল গেল, রাস্তা-জায়গার নাম বদলালো, কলকাতা ভারতের প্রথম শহর যেখানে মেট্রো চালু হল কিন্তু তাও কারও মনে হল না ওঁর নামে একটা স্টেশন হোক। কেন কেউ ভাবেননি জানি না। নতুন মূর্তি, বাড়ি সহ সব কিছুই হল, বাংলা অনেক কিছুর সাক্ষী থেকেছে। তাও বিনোদিনী দাসীর নামে কিছু হয়নি। এখন স্টার থিয়েটারের নাম বদলালো বলেও লোকে নানা কথা বলছে যে ওটা তো সিনেমা হল, উনি তো সিনেমা হল চাননি। কেউ আবার বলছেন ওটা বিনোদিনীর বানানো স্টার থিয়েটার নয়। তাহলে ওঁরা কোন থিয়েটারের কথা বলছেন? কলকাতার বুকে তো একটাই স্টার থিয়েটার ছিল কিছুদিন আগে অবধি। সেটাই বিনোদিনী থিয়েটার হয়েছে। আসলে নিন্দে করতে চাইলে পূর্ণিমার চাঁদ নিয়েও করা যায়।
অনেকে তো এটাও বলছেন যে দেব প্রযোজক বলেই রুক্মিণীকে মুখ্য চরিত্রে নিয়েছেন।
রামকমল: মানুষ নিজের মতো নিজেরা ন্যারেটিভ বানিয়ে নেয়। আর যেহেতু তাঁরা সেটা গড়েছেন, সেটা তাঁদের ভাঙতে কষ্ট হয়। জল্পনায় কতটা সততা আছে কতটা নয়, সেটা কেউ দেখে না। রুক্মিণী আছে মানেই সবাই ভেবে নিয়েছে দেবও আছে। দেব তাঁর নিজের মতো আলাদা একজন অভিনেতা, আর তাঁর প্রযোজিত ছবিতে কাকে কোন চরিত্রে নেওয়া হবে সেটা পরিচালক ঠিক করেন। যদি পরিচালক মনে করেন যে তাতে রুক্মিণীকে নেওয়া হবে, তবেই নেওয়া হয়। দেব ভীষণ প্রফেশনালি কাজ করেন। আমরা যখন এই প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে যাই আমায় আর রুক্মিণীকে প্রপার ইমেইল করে সময় নিয়ে যেতে হয়েছিল। ওঁর অফিসে গিয়ে প্রপার আমাদের আলোচনা হয়েছে সব বিষয়টা নিয়ে। খালি দেব আমার বা রুক্মিণীর বন্ধু বলে, আর বন্ধুছলে খেলা করতে করতে সিনেমা বানানো হয়নি কিন্তু।
বিনোদিনীর পর, আগামীতে আশা করছেন যে বাংলায় আরও মহিলাকেন্দ্রিক ছবি হবে? মহিলাকেন্দ্রিক ছবি হলে তাতে বিনিয়োগ করা হবে? কী মনে হয়?
রামকমল: একদম। আমি তো চাই এমন ছবি হোক আরও বাংলায়। সমৃদ্ধ, গ্ল্যামারাস, মিউজিক্যাল কমার্শিয়াল বড় পর্দার ছবি হোক, যেটা আমরা হারিয়ে ফেলছি। খাদান বড় পর্দার ছবি, সেটা মানুষকে হলমুখী করার চেষ্টা করল, হল-ও। কিন্তু বড় পর্দার ছবি বলে অনেক সময় সিনেমা হলে গিয়ে দেখে মনে হয় সিরিয়াল দেখছি যেটা বাড়িতে সাড়ে ছয়টায় দেখি, সেটার তো কোনও মানে হয় না। তাই জন্য লোকে OTT- মুখী হয়েছে। আজ চারজন যদি সিনেমা হলে ছবি দেখতে যান ২০০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। তাহলে মানুষ দেখছে আমি ২০০০ টাকা দিয়ে একটা বছরের সাবস্ক্রিপশন পেয়ে যাব একটা OTT মাধ্যমের তাহলে আমি কেন সিনেমা হলে গিয়ে একটাই সিনেমা দেখব? আবার এই বাঙালিরাই কিন্তু পুষ্পা, বাহুবলী হাউজফুল করছে। লার্জার দ্যান লাইফ যেই ভাবা হচ্ছে এই দর্শক কিন্তু গিয়ে হল ভরাচ্ছে। এই দর্শক গিয়ে স্ত্রী দেখছে। তার মানে তাঁরা জানে বড় পর্দায় গিয়ে দেখার মতো মজা যদি তাঁরা কোনও ছবিতে পাবেন তাহলে তাঁরা সেটার জন্য টাকা খরচ করবেন। সিরিয়ালের মতো লাগলে কিন্তু OTT-র জন্য অপেক্ষা করবে।