সোমবার ২০ জানুয়ারি হল আরজি কর কাণ্ডে জড়িত সঞ্জয় রায়ের সাজা ঘোষণা। আর সঞ্জয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিলেন বিচারক অনির্বাণ দাস। তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনাকে বিরল থেকে বিরলতম অপরাধ বলে মনে করছেন না। তাই আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই রায় নিয়ে হতাশা ধরা পড়েছে সাধারণ মানুষ থেকে তারকা, অনেকের গলাতেই।
হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার তরফে বিজেপি নেতা ও অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি স্পষ্ট জানালেন, ‘এই রায়ে আমরা কেউই খুশি নই। একা সঞ্জয়ের শাস্তিতে তো কেউই খুশি হতে পারে না! আর তার ওপর যাবজ্জীবন!’
রুদ্রনীল নিজের বক্তব্যে জুড়েছেন, ‘লোয়ার কোর্টের মহামান্য বিচারকের উপর তো আমরা কেউই কথা বলতে পারি না। কিন্তু একটা অদ্ভুত জিজ্ঞাসা মানুষের মনে তৈরি হয়েছে। এই একটাই ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণ যদি আপনাদের হাতে থাকে, (যে তথ্যপ্রমাণ পুলিশ সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে, ৪ দিন নিজেরা তদন্ত করে), তাহলে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হল না কেন? পুলিশের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের প্রচুর অভিযোগ এসেছে। একথা বলাই যায় সিবিআই খড়ের গাঁদায় সূঁচ খোঁজার মতো কঠিন কাজ নিয়ে নেমেছিল। তার পরেও যদি শুধুমাত্র সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধেই প্রমাণ পাওয়া যায়, যে ও-ই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, তাহলে কোন মহানুভবতার জায়গা থেকে মহামান্য বিচারক মৃত্যুদণ্ড দিলেন না? যেখানে সিবিআই বারবার বলেছে, সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, কেন সম্মানীয় বিচারক যাবজ্জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেন, তা সম্মাননীয় বিচারপতিই বলতে পারবেন।’
সঙ্গে রুদ্রনীল স্পষ্টভাবে জানালেন, কোনও ভাবেই তিনি এখনও বিশ্বাস করেন না যে, এই ঘটনা একটা মানুষ ঘটিয়ে থাকতে পারে। সঙ্গে কলকাতা পুলিশের দিকে আঙুল তুললেন ‘তথ্য-প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ’ এনে। তাঁর কথাতে পাওয়া গেল, ‘তৃণমূলের বড় বড় মাথাদের জড়িত থাকা’র অভিযোগ।
রুদ্রনীল বললেন, ‘সঞ্জয় রায়, যাকে দুটো পতিতালয়ে ঘোরার পর ডেকে আনা হয়েছিল আরজি করে। কারা ডেকেছিল? সেই তথ্যপ্রমাণ কি আদালতের বিচারপতির কাছে আসেনি? অবশ্যই এসেছে। তাহলে যারা ডেকেছিল তাঁদের নিয়ে কী বিচার হল, আমরা বুঝতে পারলাম না। পুলিশ আমাদের মৃতা বোন অভয়া বা তিলোত্তমার ব্যবহার করার সমস্ত জিনিস একেবারে সাফ করে তুলে দিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে, দেখা গিয়েছে যে ব্যবহার করছে তারও কোনো ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই। এ আমরা সবাই জানি। যা নিয়ে তুমুল আলোচনাও হয়েছে। যাই হোক না কেন, সিবিআইয়ের কাজটা অনেক কঠিন ছিল। কারণ, যেটুকু প্রমাণ পুলিশ রাখতে চেয়েছে, ততটুকু প্রমাণই ছিল। আমার মনে হয় না তদন্ত প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়েছে, বাকি অন্যান্য এভিডেন্সগুলো যা আছে, সেগুলো তরান্বিত করে যাওয়ার কাজ সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে।’
‘এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত, রাজ্য প্রশাসনের বড় বড় লোকেরা জড়িত আছেন, তাই বাকি অপরাধীদের বাঁচাতে প্রথম থেকেই শুধু 'সঞ্জয় সঞ্জয়' করে, তিনই ‘একা করেছেন’ বলে ছাপ মারার চেষ্টা হয়েছে। আমার মনে হয়, সিবিআই সেই বিষয়ে সতর্ক। সিবিআইয়ের কাছে অনুমেয় হয়েছিল, লোয়ার কোর্টে কী প্রমাণ করতে চাইছিল রাজ্য প্রশাসন। তাই সেরকই করেছে। এই রায়ে আমরা কেউই খুশি নই। কিন্তু আদালতের রায় মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া তো কোনো উপায় নেই আমাদের। কিন্তু আমি নিশ্চিত হাইকোর্টে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ হবেই। এই ৫০জন সাক্ষী, তাঁদের বয়ান, ৪ দিন ধরে পুলিশের তথ্যপ্রমাণ লোপাট, সেদিন ডিউটিতে কারা ছিল তার লগ লিস্টও সিবিআইয়ের কাছে আছে। কেউ ছাড় পাবে না। আমি নিশ্চিত সেগুলো লোয়ার কোর্টে পেশ করে, তাঁদের খেলার তাস আগে থেকে খুলে দিতে চায়নি সিবিআই। রাজ্য প্রশাসন তো প্রথম থেকে বলে এসেছে, মুখ্যমন্ত্রী সমেত, 'সঞ্জয় দোষি। ওকে ফাঁসি দেওয়া হোক। বিচার তো একটা পদ্ধতি। লোয়ার কোর্টও একটা পদ্ধতি। আমরা এই পদ্ধতির দিকেই তাকিয়ে থাকব। আশা করব লোয়ার কোর্টে না বলা প্রমাণ, সিবিআই তুলে ধরবে হাইকোর্টে। ওই রাতে কারা কারা ছিল। অভয়া বা তিলোত্তমার মা-বাবাও প্রশ্ন করেছেন, সেইরাতে কারা কারা ছিল, বাকি জুনিয়র ডক্তাররা কেন এরকম একটা মারণপণ ষজ্ঞ হওয়ার পরও জানতে পারল না? এটা কীভাবে সম্ভব? এই সমস্ত পাতা কিন্তু খোলা হবে হাইকোর্টে গিয়ে।’
তবে সিবিআইয়ের দতন্ত পদ্ধতি বা তদন্ত পদ্ধতির স্বচ্ছতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক মহল-সহ সমাজমাধ্যমে, তা নিয়ে প্রতিবাদ করলেন রুদ্রনীল। বললেন, ‘অনেকে শুনতে পেলাম আবেগের জায়গা থেকে বলছেন, কেউ রাগের জায়গা থেকে সিবিআইয়ের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। মনে রাখতে হবে, সিবিআইয়ের কাজে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিল মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। এবং যেখানে ডাক্তারদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন, তিলোত্তমার বাবা-মায়ের আইনজীবীও ছিলেন। সিবিআইয়ের কাজে যে তাঁরা অসন্তুষ্ট, তা কিন্তু দু পক্ষের কেউই কড়া ভাবে বা প্রমাণিত ভাবে সুপ্রিমকোর্টে জানাননি। অর্থাৎ, সুপ্রিমকোর্টের কাছে সিবিআই নিয়ে কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। আমি নিশ্চিত জমা পড়লে, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতেন।’
‘এটা একটা স্ট্যাটেজিকাল গেম। মনে রাখতে হবে, আমাদের বাস্তবের সঙ্গে, আইনের পদ্ধতি অনেক সময়ই মেলে না। ব্যক্তিগত জীবনে বিচার বা প্রমাণ আর আদালতের বিচার বা প্রমাণ অনেকটাই আলাদা। এই স্ট্র্যাটেজির খেলা আগামীতে হাইকোর্টে হবে। যারা জড়িত, যারা-যারা সঞ্জয় রায়কে ডেকে এনেছিল, পুলিশ বা ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী, যদি কেউ দোষী হন, তাহলে ছাড় পাবেন না। মন খারাপ, কিন্তু সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছি আমরা।’