সম্প্রতি বাংলাদেশ বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের বই রাখায় রীতিমত ভাঙচুর চালানো হয় সব্যসাচী প্রকাশনার স্টল। মারধর করা হয় প্রকাশক শতাব্দী ভবকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগরে দেন লেখিকা। শুধু তাই নয়, কলকাতা বইমেলার সময়ও তসলিমা জানিয়েছিলেন, তিনি যে কলকাতা বইমেলায় আসতে পারেন না, সেটার জন্য তাঁর ক্ষোভ আছে। সমস্ত বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে এদিন হিন্দুস্থান টাইমস বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল লেখিকার সঙ্গে। কী জানালেন তিনি?
বাংলাদেশ বইমেলায় আপনার বই খালি ব্রাত্যই নয়, রাখলেও ‘অপরাধ’ বলে গণ্য করা হচ্ছে। এটা নিয়ে কী বলবেন?
তসলিমা নাসরিন: এখন যেহেতু ইউনুস সরকার এদের আন্দোলনের ফলেই, এদের জন্যই ক্ষমতায় এসেছে তাই এদের সাপোর্টেই কথা বলছে। সরকার থেকে কোনও সাহায্য করছে না। যদিও তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমি মনে করি না যে এই জিহাদিদের বিপক্ষে সরকার কিছু করবে। সারা দেশ জুড়ে যে আগুন জ্বালাও, পোড়াও চলছে, ভাঙচুর চলছে; পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর, ভাস্কর্য, জাদুঘর এসবের বিরুদ্ধে সরকারের তরফে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সেই জন্যই আশা করি না যে কিছু হবে। বইটার বিরুদ্ধে সমস্যা নয় কিন্তু, ওটা আমার বই তাতেই সমস্যা। ওটা যে স্টলে আছে সেই স্টল পুড়িয়ে দেবে, সে স্টলের প্রকাশককে মেরে ফেলবে এই মর্মে অনলাইনে, ফেসবুকে পোস্ট করে লোক জড়ো করেছিল। তখনই সব্যসাচী প্রকাশনার যে প্রকাশক শতাব্দী ভব পুলিশকে, বাংলা একাডেমির পরিচালককে জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা তাতে সমাধান দিয়েছেন, ‘বইটা সরিয়ে ফেল’। বাংলা একাডেমির নির্দেশে বইটা তাঁরা সরিয়ে ফেলেছেন। যেহেতু বইটা আমার লেখা সেহেতু তাঁদের এত ক্ষোভ, এত আক্রোশ। তাই তাঁরা ভেবেছিলেন বইটা সরিয়ে ফেললে হয়তো আর কোনও সমস্যা হবে না। ওই জিহাদিরা যখন স্টল আক্রমণ করে তখন শতাব্দী স্টলে ছিলেন, তিনি প্রশ্ন করেন যে ‘কেন এই বই সরাতে হবে, তসলিমা কি নিষিদ্ধ, ওঁর এই বই কি নিষিদ্ধ?’ না, এই বই তো নিষিদ্ধ নয়। তসলিমা নিজেও তো এই দেশে নিষিদ্ধ নন। তসলিমাকে যে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না, সেটা সরকার অবৈধ ভাবে দিচ্ছে না। কিন্তু জিহাদিরা তো ওসব শোনে না। ভাঙচুর করার পর পুলিশ একজনকেও গ্রেফতার করেনি। পুলিশ যখন শতাব্দীকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কন্ট্রোল রুমের দিকে তখন জিহাদিরা ওঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওঁকে এত মেরেছে যে উনি ভেবেছিলেন হয়তো মরেই যাবেন। কিন্তু একজন পুলিশ ওঁকে একপ্রকার ছোঁ মেরে সরিয়ে নিয়ে যায় কন্ট্রোল রুমের মধ্যে। কিন্তু তারপরও জিহাদিরা ওই কন্ট্রোল রুমের বাইরে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে ওঁকে মেরে ফেলার জন্য। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার, কিন্তু এই জঙ্গি-জিহাদি যারা ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, ভাঙচুর করেছে, এদের তো কই গ্রেফতার করেনি। এদের তো তখন গ্রেফতার করতে পারত। গ্রেফতার করল প্রকাশককে। থানায় নিয়ে যায়নি যদিও, কিন্তু ওঁর জীবনের তো নিরাপত্তা নেই এখন। ওঁর স্টল বন্ধ। উনি কিছু বই বিক্রি করে খান। ওঁর জীবিকার কী হবে? পুলিশ কেন ওঁকে নিরাপত্তা দিচ্ছে না? কেন ওঁর স্টল বন্ধ করতে হবে? যেহেতু জিহাদিরা চাইছে তাই স্টল বন্ধ করতে হবে? গোটা মাস চলে এই বইমেলা, সেখানে একজন প্রকাশককে হুমকি দিয়ে তাঁর স্টল বন্ধ করা যায়? তাঁকে বের করে দেওয়া যায় এভাবে বইমেলা দিয়ে? এটা তো অন্যায়।
আরও পড়ুন: জমাটি অ্যাকশনেও দুর্বল প্রথম ভাগ, শিউরে ওঠা সেকেন্ড হাফে তাক লাগালেন ভিকি! কেমন হল ছাবা?
কিন্তু একটা স্বাধীন দেশে এভাবে...
তসলিমা নাসরিন: (ব্যঙ্গের হাসি হেসে) স্বাধীন! স্বাধীন বলা... (একটু থেমে) স্বাধীন থাকলে তো হতো না। এটা তো নতুন কিছু না। ১৯৯১, ৯২ সালেও আমার বই এই জিহাদিরা পুড়িয়ে দিত। বাংলা একাডেমি, সরকার তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে আমার বিরুদ্ধে নিত। আমার বই যেন কোনও স্টল না রাখা হয়, নির্দেশ থাকত একাডেমির। আমায় বলা হতো আমি যেন বইমেলায় না আসি। যখন 'লজ্জা' বিক্রি হচ্ছিল সেবারও এরম জিহাদি, ধর্মান্ধদের ভিড় হয়ে গিয়েছিল। তারা স্টল আক্রমণ করেছিল, ঢিল ছুঁড়েছিল। আমায় আক্রমণ করা হয়। এসব নতুন কিছু নয়। আগেও কোনও সরকার প্রতিবাদ করেনি, পদক্ষেপ নেয়নি। না খালেদা, না হাসিনার সরকার করেছে, না ইউনুস সরকার করছে। এই জিহাদিদের সামনে সবাই নতজানু, সবাই আত্মসমর্পণ করে। যাঁরা নির্দোষ তাঁদেরকেই গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নেয়। আমরা যে পরিবর্তন করতে বলি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বলি, সেটার মধ্যে মূল নীতি হল বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু এগুলো শুনছে কারা? বাকি প্রকাশকরা যে একটু সাহসী হবেন, বলবেন যে আমরা প্রকাশকদের উপর আক্রমণ, অন্যায় মানছি না সেটাও তো বলছেন না। তাঁরা যদি বলেন যে আমাদের সবার নিরাপত্তা চাই, নইলে আমাদের উপরেও এমন আক্রমণ হতে পারে সেটাও তো কেউ বলছেন না। কোনও লেখক প্রতিবাদ করলেন কি? সবাই মুখ বুজে আছেন। আসলে এসব বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এঁরা সবাই স্বার্থপর হয়ে উঠেছেন।
এখন ইন্টারনেটের যুগে এভাবে পাঠককে পছন্দের লেখক, লেখিকার বই পড়া থেকে আটকানো যায় বলে মনে করেন?
তসলিমা নাসরিন: আটকানো যায় না হয়তো। পিডিএফ , ই-বুক আছে, অনলাইনে অর্ডার করার সুবিধা আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে বইমেলাতে কেন প্রকাশকরা একটা প্রিন্টেড বই বিক্রি করতে পারবেন না? স্রেফ জিহাদিরা চায় না বলে? অন্য কিছু অল্টারনেটিভ হবে কেন? বইমেলায় গিয়ে বই কেনাও তো একটা স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা থাকবে না কেন?
খালি বাংলাদেশ নয়, কলকাতা বইমেলাতেও আপনাকে আসতে দেওয়া হয় না, আপনি নিজেই জানিয়েছেন। পাঠকের পছন্দের হলেও, রাষ্ট্র/রাজ্যের এই অনাদরের কারণ কী বলে মনে করেন?
তসলিমা নাসরিন: কলকাতাতেই তো প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কলকাতা বইমেলা তো দূরের কথা। কী কারণে আমাকে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে? বাংলাদেশ তো অনেক বড় জিহাদিদের দেশ। পশ্চিমবঙ্গকে তো বাংলাদেশের থেকে বেশি সভ্য ভাবতাম। সভ্য, শিক্ষিত, সচেতন মানুষের বাস পশ্চিমবঙ্গে, সেটাই জানতাম। কিন্তু সেটাও তো ভুল প্রমাণিত হল। আমি একটা নিরীহ, নির্যাতিত, নির্বাসন দণ্ড পাওয়া একজন লেখক যে বাংলাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। যখন ইউরোপে থাকতাম তখন প্রাণের টানে চলে এসেছিলাম কলকাতায় থাকতে। কিন্তু সেটাও দেওয়া হল না। কত অনুষ্ঠান হয়, বইমেলা হয়, কত মানুষ চান যে আমি ওখানে যাই। কিন্তু অধিকার নেই আমার ওখানে যাওয়ার।
কিন্তু কেন? তসলিমা নাসরিন মানেই স্পষ্ট কথা স্পষ্ট ভাবে। সেটাকেই কি ভয় পায় সবাই?
তসলিমা নাসরিন: আমাকে অত্যাচার করলে কেউ বা কোনও রাজনৈতিক দল আমার পাশে দাঁড়াবে না। কোনও সংগঠন আমার পাশে দাঁড়াবে না। আমার তো কেউ নেই। আমি একটা ভালো সফট টার্গেট। আমার উপর অন্যায় করলে নির্যাতন করলে কোনও ক্ষতি হয় না কারও। এতে কী লাভ হয় কার, আদৌ কোনও লাভ হয় কিনা জানি না। অনেকে বলেছিল পঞ্চায়েত ভোটে জিতবে বলে সিপিএম আমায় তাড়িয়েছিল, কোথায় জিতল? তাহলে কী লাভ হয়েছিল সিপিএমের আমায় তাড়িয়ে?
সবারই কোথাও একটা পিছুটান থাকে, সেখানে নিজের দেশ, জন্মভিটেতে ফিরতে না পারার কষ্ট হয় না? একবিংশ শতাব্দীতেও এই অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতাকে কীভাবে দেখেন?
তসলিমা নাসরিন: কষ্ট হয়। অনেক লেখক নির্বাসন নিয়ে কাটিয়েছেন, কিন্তু সরকার বদলের পর তাঁরা আবার ফিরে যেতে পেরেছেন দেশে। কিন্তু এটা কোনও লেখকের বেলায় হয়নি যাঁর ৫ টা বই দেশে নিষিদ্ধ, যে নিষেধাজ্ঞা কোনও সরকারই ওঠায়নি। আমাকে কোনও সরকারই দেশে ফিরতে দেয় না। পৃথিবীর কোনও লেখকের বেলায় এমন ঘটেনি। আমার বেলায় ঘটছে। কেন ঘটছে? সেটার কারণ মৌলবাদী, জিহাদি, জঙ্গিরা আমার বিরুদ্ধে, কারণ আমি ইসলামের সমালোচনা করেছি। কেন ইসলামে নারীকে সমানাধিকার দেওয়া হয়নি, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। আমি তো বৈষম্যহীন, সুস্থ, সুন্দর সমাজ গঠনের কথা বলি। রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ থাকার কথা বলি। রাষ্ট্র এবং ধর্ম যেন পৃথক থাকে, ধর্মনিরপেক্ষ হলে নারীরা সমান অধিকার পাবে, সেই সব কথা আমি ক্রমাগত লিখছি। তাই যারা নারীবিদ্বেষী, মানবাধিকার মানে না, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী তারা তো আমার বিপক্ষে যাবেই। যেহেতু আমার পাঠক আছে সেহেতু তারা মনে করে আমার কারণে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চলে আসবে, নারীরা অধিকার পাবে। তখন ধর্মের নামে নারীকে নিষ্পেষণ করতে পারবে না। তারা যে অমুসলিমদের নির্যাতন করে, সেটা করতে পারবে না। আমার লেখা পড়ে যদি মানুষ অনুপ্রাণিত হয় তাহলে তারা মৌলবাদের বিপক্ষে চলে যাবে। সেই ভয়েই, আশঙ্কায় আমি যেন না ফিরতে পারি সেই চেষ্টা করে। প্রতিটা সরকার এদের তেল দিয়ে, তোষণ করে চলে। তাই আমাকে ফিরতে দেয় না। ভাবে আমায় ফিরতে দিলে মৌলবাদীরা তাদের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। সেটা তারা চায় না। আমায় তো আনুষ্ঠানিক ভাবে নিষিদ্ধ করতে পারে না, আমি তো একজন নাগরিক। আমায় নিষিদ্ধ করবে কীভাবে? কী কারণে? আমি কি খুন করেছি? কটা খুন করেছি? যারা খুন করে তারাও তো ওই দেশে থাকে।
আরও পড়ুন: পরনে লাল শাড়ি, টোপর! বধূবেশে মনোজ মুরলির বাহুলগ্না দেবলীনা, 'ফের গৌরবের ডিভোর্স?' প্রশ্ন নেটপাড়ার
এদেশে বসে নিয়মিত ও দেশের খোঁজ রাখেন, সেই বিষয়ে লেখালিখি করেন, কখনও মনে হয়নি যে যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করি তাহলে হয়তো দেশে ফিরতে পারব?
তসলিমা নাসরিন: আমি তো কোনও আপস করে চলতে চাই না।