বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হত ৯৬ বছর। বাংলা, অসমীয়া এবং হিন্দি ভাষার জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। তাঁর কণ্ঠে সুরের মূর্চ্ছনায় মানবতাবাদী সঙ্গীত মন ছুঁয়ে গেছে সঙ্গীতপ্রেমীদের। বৃহস্পতিবার ‘ভারতরত্ন’ ভূপেন হাজারিকার জন্মবার্ষিকী। আর এই বিশেষ দিনে গুগলের তরফে বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হল প্রয়াত শিল্পীকে। গুগল ডুডলে দেখা গেল হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন ভূপেন হাজারিকা। মুম্বইনিবাসী শিল্পী ঋতুজা মালি-র তৈরি এই ইলাস্ট্রেশন মন কাড়ছে সবার।
একদিকে কবি, অন্যদিকে গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক- ভূপেন হাজারিকার কর্মজগতের ব্যাপ্তি অনেকখানি। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই কিংবদন্তি শিল্পী অসমিয়া লোকগানকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন নিজ দক্ষতায়।
১৯২৬ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর অসমের তিনসুকিয়ার অখ্যাত সাদিয়া গ্রামে জন্ম তাঁর। এরপর ব্রহ্মপুত্রের তীরে বেড়ে ওঠা সেখানকার সংস্কৃতি আর লোকগানকে আঁকড়ে।
শৈশবেই ভূপেন স্থানীয় বরগীত, গোয়ালপাড়ার গান, চা–মজদুরের গান, বিহুগীতসহ গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন ও প্রভাবিত হন। পরবর্তীকালে অসমিয়া গীতিকার জ্যোতিপ্রসাদের নজরে পড়ে যান তিনি। হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের ওস্তাদ বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার হাত ধরেই এরপর তাঁর পথচলা। মাত্র ১০ বছর বয়সে শুরু হয়ে যায় তাঁর মিউজিক্যাল কেরিয়ার।
এরপর যখন ভূপেন হাজারিকার বয়স ১২, তিনি দুটো ছবির গান লেখেন এবং রেকর্ড করেন। আস্তে আস্তে ভূপেন হাজারিকা অজস্র গান কম্পোজ করতে শুরু করেন। গানের মাধ্যমে গল্প বলার এক অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাঁর। ভূপেন হাজারিকার গান বলত আনন্দ, দুঃখ, বিরহ-মিলন, প্রেম, একাকীত্ব-র মতো আবেগের কথা।
শুধু সঙ্গীত সাধনাই করেননি এই শিল্পী, পড়শোনাতেও ছিলেন তুখোড়। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতোকত্তর ডিগ্রী লাভ করেন, এরপর মার্কিন মুলুকে গিয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস কমিউনিকেশনের পিএইচডি সম্পন্ন (১৯৫২) করেন।
পড়শোনা শেষ করে ফিরে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অধ্যাপনার কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় আসেন এবং ফের সঙ্গীত পরিচালনার কাজে হাত দেন। পাশাপাশি আইপিটিএর (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) সক্রিয় কর্মী ও নেতা হিসেবে গণনাট্যের কাজ চালিয়ে যান।
তাঁর বর্ণময় কেরিয়ারে বহু স্বীকৃতি এবং সম্মান পেয়েছেন ভূপেন হাজারিকা। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে জাতীয় পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড, পদ্মশ্রী (১৯৭৭), দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৯২), পদ্ম ভূষণ (২০০১)-এর মতো পুরস্কার। তাঁরে মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ (২০১১) এবং ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন (২০১৯) দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
২০১১ সালের ৫ই নভেম্বর মাল্টি-অর্গ্যান ফেলিউরের কারণে মুম্বইয়ে মৃত্যু হয় এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর। অসমে তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ।
সুরের ভেলায় ভাসতে ভাসতে তিনি হয়ে উঠেছেন যাযাবর, কখনও আবার গানের মাধ্যমেই দিয়েছেন জীবনকে খুঁজে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন, দিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসার বার্তা- তাই দেশবাসীর অন্তরে আজীবন গেঁথে থাকবেন তিনি।