নুসরত ফারিয়া, অভিনেত্রী, গায়িকা, বাংলাদেশ
আজও এই (২১ ফেব্রুয়ারি) দিনটা এলেই আমি এক ঝটকায় ছোটবেলার স্মৃতিতে ফিরে যাই। ভাষাদিবসে সাদা-কালো শাড়ি পরে স্কুলে অনুষ্ঠান করতাম। তখন আমার কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি মানে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ভীষণ মনে পড়ে সেসব কথা। ছোটবেলার স্মৃতি সবসময়ই মধুর হয়। যদিও এখন আবার এই দিনটা একটু অন্যভাবে পালন করা হয়। এইদিনে কোথাও না কোথাও অনুষ্ঠান থাকেই, সেখানে যেতে হয়। আর একন্ত ছুটি থাকলে বাসাতেই কাটাই। এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্কুল জীবনের স্মৃতিগুলিই আসলে বেশি সুন্দর।
২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমার দাদার (দাদু) কাছে একসময় অনেক গল্প শুনেছি। দাদা বলতে আমার বাবার বাবা। আজ উনি নেই, তাই এই দিন নিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে গল্প বলারও কেউ নেই। পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন বই পড়ে, ডকুমেন্টরি দেখে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কিছুটা জেনেছি, কারণ আমি ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত কিছু ছবিতে কাজ করেছি। আর সেকারণেই কিছুটা রিসার্চ করেছিলাম। যদিও সেই ইতিহাস ঘাঁটলে আঘাতই পাই বেশি, কষ্ট হয়। কারণ, ওই গল্পগুলো শুনতে ভালো লাগে না, সেগুলো অনেক কষ্টের। আজ আমরা বাঙালি হিসাবে উৎসব করছি, তবে একদিন এর জন্যই অনেক রক্ত ঝরেছে। আসলে আমার মনে হয় ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে উন্মাদনার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ আমরা এই ইতিহাস থেকে কতটা শিখেছি, আর জীবনে সেটা কীভাবে কাজে লাগাচ্ছি।
২১ ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব আমাদের বাংলাদেশের মানুষের কাছে চিরকাল থাকবে। কারণ, বাঙালি এমনই একটা জাতি যাঁরা ভাষার জন্য লড়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন এবং যুদ্ধও করেছেন। আমার মনে হয়, বাংলা ভাষা হল ভীষণই মিষ্টি একটা ভাষা, আর গোটা বিশ্বের মধ্যে যে ভাষার সবথেকে বেশি উদযাপন হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের কাছে চিরকালের জন্যই একটা আনন্দের দিন। তবে বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দে অনেক দুঃখও মিশে আছে, আজকের এই আনন্দের জন্য একদিন অনেক জীবন বলি হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবস, ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনও আবেগ নেই, সেকথা বিশ্বাস করি না। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই বুঝতে পারবেন, এপ্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছেও এই দিনটা নিয়ে কতটা আবেগ জড়িয়ে আছে। সকলেই এই দিনটা উদযাপন করেন। হয়ত উদযাপনের ধরন বদলেছে। আশারাখি, পরের প্রজন্মের মধ্যেও এই আবেগ প্রবাহিত হবে। এই আবেগ আমাদের রক্তে রয়েছে। এই উদযাপন আসলে আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ।
ইংরাজি এখন আন্তর্জাতিক স্তরের ভাষা। ওই ভাষা বলা দোষের নয়। তবে বাংলার সঙ্গে ইংরাজি মিশিয়ে বিকৃত করে কিছু করলে তাতে আমার আপত্তি আছে। ইংরাজি-বাংলা দুটো ভাষা আলাদা ভাষা। যেটা যেমন সেটা তেমন করে বললে তাতে আপত্তির কিছু নেই। আর এখন তো শিক্ষা ব্যবস্থাও বদলেছে। একটা সময় শুধু বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা হত, এখন বাংলার পাশাপাশি ইংরাজি মাধ্যমেও পড়াশোনা হয়। আমিও ইংরাজি মাধ্যমে পড়েছি, ক্লাসে ইংরাজিতেই কথা বলতে হত। সেকারণে ইংরাজিটা এখন আমার কিংবা আরও অনেকের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। তবে বাড়িতে আমি-ই বাংলাতেই কথা বলি। তাই যখন যে ভাষায় কথা বলবেন, সেটা সঠিকভাবে বললেই আর কোনও সমস্যা থাকে না।
বাংলা ভাষার শিল্পী হিসাবে বাংলা গান, সিনেমার জন্য আরও বেশি কাজ করতে চাই। আমার গানে বাংলাও থাকে আবার পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবও থাকে। আমি চাই না, কোথাও মনে হোক আমরা অচল, সেকেলে। আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা সবকিছুই পারি, আর সেকারণেই আজ গোটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরছি, বাংলা ভাষাকে তুলে ধরছি।
নুসরতের সাক্ষাৎকারের অনুলিখন