ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই থামিয়ে বুধবার না-ফেরা দেশে চলে গিয়েছেন ইরফান খান। কিন্তু ইরফানের স্মৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছেন তাঁর পরিবার ও গুণমুগ্ধ ভক্তরা।গত দু বছর ধরে মারণরোগের সঙ্গে যখন লড়াই করেছেন ইরফান, সেই লড়াইয়ে সারাক্ষণ পাশে থেকেছেন তাঁর পত্নী। সেই লড়াই নিয়েই এবার মুখ খুললেন তাঁর স্ত্রী সুতপা শিকদার।
শুক্রবার ইরফান খানকে নিয়ে খোলা চিঠি লিখলেন তাঁর স্ত্রী এবং দুই পুত্র-বাবিল ও অয়ন। সেখানে ইরফান পত্নী জানান- কী করে বলব আমি একাই সবটা হারিয়েছে,কারণ আমি জানি হাজারো মানুষ আমার এই শোকে শামিল। তাঁরাও তো স্বজন হারানোর ব্যাথা পেয়েছে। আমার দুঃখে তাঁরাও সমব্যাথী।
ইরফানের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। স্ত্রীর কাছে এটা অবিশ্বাস্য যে আগামী দিনগুলো ইরফানকে ছাড়া বাঁচতে হবে। তবুও স্বামীর শব্দ ধার করে তিনি বলেছেন 'ইটস ম্যাজিক্যাল। যে জাদুবলে ইরফান আজীবন তাঁর পাশে থাকবেন। ইরফান যেভাবে তাঁকে বাঁচতে শিখিয়েছেন,সেভাবেই ভবিষ্যতের দিনগুলিতে চলার চেষ্টা করবেন। হয়তো পারবেন না কিন্তু চেষ্টা করবেন, যাতে দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনপথের এই নৌকো সঠিকভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে।
স্বামী ইরফানের উপর একটা কারণেই অভিমান রয়েছেন সুতপার। ‘সারাটা জীবন কেন যে আমাকে এতটা আদরে রেখেছিল, কেন মেনে নিয়েছিল আমার সব আবদার? ওঁর পারফেকশনিস্ট মনোভাবটাই আমাকে কিছুতেই সাধারণে সন্তুষ্টি দেয় না!’
'জীবনে সবকিছুর মধ্যে ও একটা ছন্দ খুঁজে নিত। যতই শ্রুতিকটূতা থাক কিংবা চিত্কার-ও একটা রিদম ঠিক খুঁজে পেত। আমিও ওর তালে তাল মেলাতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলাম।আসলে আমাদের জীবনটা অভিনয়ের মাস্টারক্লাস। তাই আমাদের জীবনে যখন অযাচিত অতিথিরা এল তখনও আমি সেই বেসুরো তালে সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করেছি'।
চিকিত্সকের প্রেসক্রিপশনটা আমার কাছে ছিল চিত্রনাট্য। আমি চেয়েছিলাম সেটা নিখুঁতভাবে মানতে। তাকে সুস্থ রাখতে কোনদিনও কিছুই মিস করিনি।শেষের দু’ থেকে আড়াই বছর আমার কাছে ছিল নাটকের মধ্যান্তরের মতো। যেখানে ইরফান চূড়ান্তভাবে অর্কেস্ট্রা বাজিয়ের ভূমিকায় পালন করছে। এই সময়টা আমাদের ৩৫ বছরের সম্পর্কের চেয়ে একেবারে আলাদা। আমাদের বিয়েটা আসলে বিয়ে নয়, ওটা এটা মিলন ছিল। আমার ছোট্ট পরিবারকে আমি একটা নৌকায় দেখতে পাই। দুই ছেলে বাবিল আর অয়ন বাবার পরামর্শ মেনে প্যাডেল করে সামনে এগিয়ে চলেছে। ইরফান বলছে ‘ওখান থেকে নয় এখান থেকে ঘোরো’। তবুও জানি এটা জীবন, সিনেমা নয়-এর কোনও রিটেক হয় না।
বাবার পরামর্শ মেনেই আমার ছেলেরা যেন প্রবল ঝড়ের মধ্যে পড়েও সেই নৌকা নিরাপদে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে- আন্তরিকভাবে এটাই কামনা করি। বাবিল বলেছে ও ইরফানের কাছে কী শিখেছে- অনিশ্চয়তার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে তার তালে তাল মেলাতে শেখা এবং এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি তোমার বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখা। অয়ন বলল, বাবার কাছে ও শিখেছে মনকে নিজের আয়ত্তে রাখা। মনকে কোনওভাবেই তোমাকে আয়ত্তে না আনতে দেওয়া।
চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়বে... আমরা যখন 'রাত কি রানি' গাছ লাগাবো যেখানে ইরফান শুয়ে আছে-যুদ্ধ জয়ের পর এক প্রশান্ত ঘুমে... সময় লাগবে জানি তবুও সেই গাছেও ফুল ফুটবে..গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে। যে গন্ধ ছুঁয়ে যাবে সেই সকল মানুষের অন্তর আত্মাকে যাঁরা শুধু ওঁর অনুরাগী নয়, যাঁরা আমাদের পরিবার'।