‘বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাব…’ জয় গোস্বামীর এই কবিতা বাঙালির প্রাণের খুব কাছের। লোপামুদ্রা মিত্রর হাত ধরে নব্বইয়ের দশকে গানের আকারে সামনে আসে ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটি। সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ‘বেণীমাধব’। সৌজন্যে সারেগামাপা-র গত সপ্তাহের পর্বে গৌতম হালদারের এই কবিতা পাঠ।
প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব গৌতম হালদারের উপস্থাপনের ধরণ অধিকাংশ মানুষেরই পছন্দ হয়নি। তাঁদের মতে একটি ক্লাসিক কবিতা ও গানকে ‘গলা টিপে হত্যা’ করেছেন গৌতমবাবু। কারুর চোখে সেটা ছিল শুধুই ‘ভাঁড়ামো’। নানারকম কটূক্তি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে জেরবার গৌতম হালদার। সেই বিতর্কে এবার আসরে নামলেন লোপামুদ্রা মিত্র। যাঁর কণ্ঠের সুবাদে এই কবিতা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
গৌতম হালদারের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর অপমানের জবাব দিলেন লোপামুদ্রা। নেটিজেনদের একহাত নিয়ে লোপামুদ্রার প্রশ্ন, ‘আমরা কি অসভ্য হয়ে যাচ্ছি?’ শনিবার সকালে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লম্বা একটি পোস্ট লেখেন লোপামুদ্রা। সেই পোস্টে আবার ছোট্ট ভুল করে ফেলায় লোপামুদ্রাকেও কটাক্ষ করতে ছাড়ল না নেটপাড়া।
গায়িকা লেখেন, ‘গৌতম হালদার…আমি তিন তিন বার তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্য মঞ্চে দেখেছি। হ্যাঁ, গৌতম হালদারের মেঘনাদ বধ কাব্য। মাইকেলের নয়।একজন সৃজনশীল নাট্যব্যক্তিত্ব , মননশীল শিল্পী গৌতম হালদার তাঁর মতো করে উপস্থাপন করেছেন, কবি জয় গোস্বামীর মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয় কবিতাটি, বিশেষ একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে। বহুদিন যাবৎ তিনি মঞ্চে নাটক, গান, কবিতা ও বিভিন্ন মাধ্যমে অভিনয় চর্চা করে চলেছেন। তাঁর নিজের শিল্প ভাবনা, তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণা রয়েছে তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে। অনেক শ্রোতা দর্শকের সেই উপস্থাপনা মনোজ্ঞ মনে হয় নি। সব কাজ সকলের ভালো নাইই লাগতে পারে। শিল্প- সাহিত্য, জীবনবোধ, সবটাই , যেটা আমার ভালো, সেটা মন্দ তোমার কাছে। এই নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।’
লোপামুদ্রা আরও বলে ১৯৯৬ সালে তাঁর গাওয়া বেণীমাধবও ঠিক লাগেনি, এমন মানুষেরও অভাব নেই। তিনি যোগ করেন, 'কবি জয় গোস্বামীর মালতিবালা, তখন সমীর চ্যাটার্জির সুরে আর আমার গলায় বেণীমাধব হয়ে উঠেছিলো। স্বয়ং কবি যে দিন প্রথম শুনেছিলেন গানটি, তাঁর প্রশ্ন ছিল , কেন একেবারে শেষে 'বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো' ফিরিয়ে আনা হল ?
কিন্তু, কবিতাটি গানে রূপান্তর করেন সমীর চট্টোপাধ্যায়। ভাবনাটা আর গান তখন হয়ে উঠেছে ওই মানুষটার সৃষ্টি। সেই ভাবনা , স্বয়ং কবি মেনে নিয়েছিলেন। আরও অনেক কবিতার গানেরই সমালোচনার সামনে পড়েছিলাম আমরা। কিন্তু কোথাও কোনও অপমানিত হতে হয়নি। শালীনতাহানি হয়নি আমাদের। সেই সময়ে তো সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, আর থাকলে কি ঘটতো জানি না। আমার আজকের এই লেখার কারণ হল, শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক, অভিনেতা, যারা দীর্ঘদিন একটা সাধনার মধ্যে দিয়ে তাঁর নিজের পায়ের তলার জমি তৈরি করেছেন, সম্মান ও শ্রদ্ধার আসন তৈরি করেছেন, তাঁদের তো বটেই, এমনকি আমরা কোনো মানুষকে প্রকাশ্যে এইভাবে অপমান করতে পারি না। অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলতে পারি না। আমরা আলোচনা করতে পারি, তাঁর উপস্থাপনা নিয়ে, কিন্তু , এরকম উচ্চমানের শিল্পীকে এভাবে কটূক্তি করতে পারি না।
শ্রোতা , দর্শক, পাঠক আমাদের ঈশ্বর। এ কথা আমার বা আমাদের শিরোধার্য।তবু, আমি প্রতিবাদ করছি। জানি, আমিও এ লেখার জন্য অথবা ভিন্ন ভিন্ন কারণে , অকারণে কুৎসিত কিছু শব্দ দেখবো আমার পাতায়। তবু, না লিখে পারলাম না। এটা অন্যায়। শালীনতা , সম্মান, ভাষার নিয়ন্ত্রণ, সমীহ, শ্রদ্ধা ইত্যাদি শব্দ কি আমরা পুরোপুরি ভুলে গেলাম। আমরা কি অসভ্য হয়ে উঠছি ক্রমশ ? কষ্ট হচ্ছে মেনে নিতে।'
লোপামুদ্রার আশঙ্কা সঠিক প্রমাণিত হতে দেরি হয়নি। বাংলায় টাইপ করতে গিয়ে, ‘মেঘনাথ বদ’ লিখে ফেলেন ‘মেঘনাদ বধের পরিবর্তে। সেই ভুল ধরিয়ে একজন কটাক্ষের সুরে লেখেন,'মেঘনাথ নয় ম্যাডাম, মেঘনাদ। তিনবার দেখেও, সঠিক নামটা জানলেন না?' নিজের ভুল মেনে নিয়ে লোপামুদ্রা পালটা লেখেন, ‘ভুল হয়েছে। বাংলা নিয়ে পড়েছি। এই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ’।