এখনও বাঙালির মনকে কাঁদায় বাঞ্ছারাম কাপালির সেই হাহাকার। তাঁর সেই 'সাজানো বাগান', আজও ঠিক তেমনই সাজানোই রয়েছে। তবে ‘বাঞ্ছারাম’ আর নেই। তাঁকে তাঁর 'সাজানো বাগান' -এর মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিতেই হল। এই ‘বাঞ্ছারাম’-এর সঙ্গে সিনে ও নাট্যপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ের সখ্যতা বহু প্রাচীন। তবু চোখের জলেই বিদায় দিতে হল বাংলা সংস্কৃতির হৃদয়ের ভীষণ কাছের এই মানুষকে। এমনকী, আজ তাই বাঙালির প্রিয় 'বাঞ্ছারাম’ মনোজ মিত্রের প্রয়াণে ‘মৃত্যুর চোখে জল’।
হ্য়াঁ, কিংবদন্তী অভিনেতা, নাট্য ব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র আর নেই। ২০২৪ এর আকাশ আরও এক নক্ষত্র পতনের সাক্ষী রইল। কিংবদন্তির মৃৃত্যুতে ফিরে দেখা যাক তাঁর গৌরবময় জীবনের ইতিহাস….।
১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর তারিখে ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলায় সাতক্ষীরা জেলার ধূলিহর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মনোজ মিত্র। প্রথমদিকে তিনি নিজের বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছেন। কারণ তার বাবা অশোক কুমার মিত্রর বদলির চাকরি ছিল। দুর্গা পুজার সময় বাড়ির উঠানে যে যাত্রা ও নাটকগুলি অনুষ্ঠিত হত তাঁর প্রতি তিনি ছোট থেকেই আকৃষ্ট ছিলেন। তবে তাঁর বাবা তাঁকে কোনওভাবেই নাটকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেননি। পরবর্তী সময়ে দেশভাগের পর বসিরহাটের কাছে ডান্ডিরহাট এনকেইউএস নিকেতনে তাঁর স্কুলজীবন শুরু হয় । পরে তিনি দর্শনে অনার্সসহ স্কটিশ চার্চ কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৫৮ সালে স্নাতক হন।
তবে কলকাতার নাট্যজগতে পা রাখার পর তিনি নিজের প্রকৃত সত্তা খুঁজে পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলার অন্যান্য বিশিষ্ট সাহিত্যিকের তীব্র প্রভাব রয়েছে তাঁর নাট্য রচনায়। খুব দ্রুতই তিনি একজন প্রতিভাবান শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি তাঁর প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ লেখেন ১৯৫৯ সালে। তবে ১৯৭২সালে চাঁকভাঙা মধু নাটকের মাধ্যমেই নাট্য জগতে পা রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে বিভিন্ন কলেজে দর্শন বিষয়েও শিক্ষকতা করেন। একসময় পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমির দায়িত্বও পেয়েছিলেন।
স্কটিশ চার্চে পড়াকালীনই তিনি থিয়েটারে দীক্ষিত হন। কলেজে নিয়মিত অনুষ্ঠান হতো। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ করেন এবং ডক্টরেটের জন্য গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু ততদিনে তিনি বাংলা মঞ্চ ও চলচ্চিত্র পরিচালক পার্থ প্রতিম চৌধুরী সহ আরও কিছু বন্ধুদের সঙ্গে মিলে তৈরি করে ফেলেছেন নাটকের দল ‘সুন্দরম’ (১৯৫৭)। পরবর্তী সময়ে এই নাটকের দলটি লেখক এবং অভিনেতা মনোজ মিত্র দ্বারাই পরিচালিত হয়। এই নাটকের দলটি বিশ্বব্যাপী ৭০০ টিরও বেশি নাটকের শো করেছে।
মনোজ মিত্রের প্রথম নাটক ‘বোগল ধীমান’ রাজ্যব্যাপী প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। এছাড়াও সাজানো বাগান, চোখে আঙ্গুল দাদা , কালবিহঙ্গো, পরবাস , অলোকানন্দর পুত্র কন্যা, নরক গুলজার , অশ্বথামা , চকভাঙ্গা মধু , মেষ ও রাখশ , নয়শো ভোজ , ছায়ার প্রশাদ , দেশ্বরম , শ্বরপদ , শ্বরপদ্ম প্রভৃতি শতাধিক নাটক তিনি লিখেছেন। এছাড়াও রয়েছে মুন্নি ও সাত চৌকিদা , রেঞ্জার হাট , জা নে ভারতে, যদিও এই নাটকগুলির বেশিরভাগই সুন্দরম, বহুরূপী প্রভৃতি দ্বারা প্রযোজনা করা হয়েছিল।
তবে শুধু নায়ক নয় বাংলা সিনেমার দুনিয়াতেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, শক্তি সামন্ত, গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকদের পরিচালনায় অভিনয় করেছেন। তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘গণদেবতা’, কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, মৃণাল সেনের 'খারিজ'-এর মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন মনোজ মিত্র। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘গণশত্রু’র মতো ছবিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
নিজের কর্মজীবনে একাধিক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন মনোজ মিত্র। যার মধ্যে রয়েছে শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৫), সেরা নাট্যকারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার (১৯৮৬), শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পুরস্কার (১৯৮৩ এবং ১৯৮৯), এশিয়াটিক সোসাইটির স্বর্ণপদক (২০০৫), শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পূর্ব (১৯৮০), বাংলাদেশ থিয়েটার সোসাইটি থেকে মুনীর চৌধুরী পুরস্কার (২০১১), দীনবন্ধু পুরস্কার (২৫ মে ২০১২) এছাড়াও পেয়েছেন কালাকার পুরস্কার।
মনোজ মিত্রের জীবন ও কর্ম চিরকালই সমাজকে প্রতিফলিত করেছে। তিনি একজন নাট্যকার, অভিনেতা এবং পরিচালক হিসেবে তিনি এমন সব গল্পকে প্রাণবন্ত করেছেন, যা মানব জীবনের বিভিন্ন জটিলতার প্রতিফলন। তাঁর স্বর্ণযুগের চলচ্চিত্রমালা এবং গৌরবময় থিয়েটারজীবন শুধু অর্জন নয়, ভারতীয় অভিনয়শিল্পের ইতিহাসে এক মাইলফলক। আজ তাই আমরা সেই সত্যিকারের শিল্পী মনোজ মিত্রকে শ্রদ্ধা জানাই, যিনি কি না নিজের কাজ দিয়ে আমাদের জাতির সাংস্কৃতিক বুননকে সমৃদ্ধ করেছেন।