মনের ভিতরের থাকা অন্ধকারে বাস ‘ডাইনি'র! নির্ঝর মিত্রের সিরিজ যেন বার বার সেই কথাই বলে। এই সিরিজ প্রতিবাদের এক ভাষা, বদলের কথা। প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত মানুষটার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প এই সিরিজ। কিন্তু মিমি চক্রবর্তী কি দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলেন? জেনে নিন।
কেমন হল ‘ডাইনি'?
এই গল্প শুধু একটা 'লতা' বা একটা 'পাতা'র গল্প নয়, এই গল্প সমাজের সেই সব মানুষের গল্প, যাঁদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। নির্ঝর তাঁর এই সিরিজের মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার দিকে আলোকপাত করেছেন। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও ‘ডাইনি’ প্রথা ঘোর বাস্তব। এখনও নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সমাজের এক শ্রেণী সাধারণ মানুষের মনে 'ডাইনি' সন্দেহের বিষ ঢুকিয়ে দেয়। আর তার জেরে বলি হতে হয় কোনও নিস্পাপ প্রাণকে।
আরও পড়ুন: 'রং মেখে ভূত', শোয়ের ফাঁকে জমিয়ে হোলি খেললেন ইন্ডিয়ান আইডল-এর প্রতিযোগীরা, কারা ছিলেন সেখানে?
সমাজ অনেক সময়ই কোনও মেয়েকে ‘ডাইনি’ বলে দাগিয়ে দেয়। আর তারপর তাঁর উপর শুরু হয় অকথ্য শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। কাটারির কোপ থেকে আগুন কিছুই বাদ যায় না সেই অত্যাচারের তালিকা থেকে। আর ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিকতার চাকায় পিষে যায় একটা অসহায়তা মেয়ের জীবন। আর সেই অমানবিক দুঃখ দেখে মজা করে সমাজের বিকৃত মানসিকতা, কিছুটা যেন কলোসিয়াম গ্যালারির প্রতিচ্ছ্ববি।
উত্তরবঙ্গে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে ‘ডাইনি’র গল্পের শুরু। হাতে কাটারি আর আগুন নিয়ে একরাশ ক্ষিপ্ত জনতা। যাঁদের দাবি গ্রামের কোনও এক মহিলার জন্যই গ্রামে মড়ক লেগেছে। আর তাই তাকে 'ডাইনি' সন্দেহে মাঠের মাঝে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে শেষ করার অয়োজন চলছে। অন্যদিকে, বিদেশ থেকে এসেছে পাতা (মিমি)। বিয়ের জন্য বাড়ি ছেড়ে লন্ডনে চলে গিয়েছিল সে। তবে বাবার সম্পত্তি ভাগের জন্য দেশে ফেরে 'পাতা'। কিন্তু ফিরে জানতে পারে বাবার সম্পর্ক সূত্রে পাওয়া বোন 'লতা'কে ছাড়া সেই সম্পত্তির ভাগ পাওয়া সম্ভব নয়। তবে লতার সঙ্গে পাতার ছোট থেকেই সম্পর্ক বেশ তিক্ত। কিন্তু সেই সবটা সরিয়ে রেখে প্রাথমিক ভাবে নিজের স্বার্থে বোনের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে সে। তবে সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, ‘ডাইনি’ সন্দেহে অত্যাচারিত হচ্ছে তাঁর 'বোনু'ই। তখন পুরানো সব কথা ভুলে নিজের সবটুকু দিয়ে তাঁকে বাঁচাতে মাঠে নামে পাতা। বোনের জন্য নিজের সব শক্তি দিয়ে লড়াই করে সে। কিন্তু এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কি তার জয় হবে? তার উত্তর দেবে 'ডাইনি'।
আরও পড়ুন: ইন্ডিয়ান আইডল থেকে এলিমিনেট হয়েই ময়ূরী কেন বললেন, 'যে চ্যাম্পিয়ন হবে সেও একদিন বাদ পড়বে'?
অভিনয় কেমন লাগল?
সিরিজে মিমির অভিনয় এক কথায় অনবদ্য। তাঁর এক্সপ্রেশন থেকে শরীর ভঙ্গি সবকিছুই ভীষণ ভাবে সাবলীল ও স্বাভাবিক। ওয়েব সিরিজের অধিকাংশ অংশে মিমির মুখে নানা ক্ষত ও রক্ত। নিজের গ্ল্যামারাস লুকে ভেঙে গল্পের স্বার্থে নায়িকা নিজেকে যে ভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে তাঁর সাহসের তারিফ না করে পারা যায় না। মিমির অভিনয় দক্ষতায় ‘পাতা'র চরিত্রকে পর্দায় আরও জীবন্ত করে তুলেছে। তবে কেবল তিনি নন, এই সিরিজে সকলেই বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। কোনও চরিত্রের ৫ মিনিট স্ক্রিন টাইম থাকলেও পরিচালক তাঁর মধ্যে থেকে সেই সময়টাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে যথার্থ অভিনয় বের করে এনেছেন। মিমির বোনের চরিত্রে কৌশানী মুখোপাধ্যায় বেশ ভালো। তবে যাঁর কথা না বললেই নয় তিনি হলেন খলনায়ক বিশ্বজিত্ দাস। তাঁর চোখ মুখে প্রকাশ পাওয়া নিষ্ঠুরতা আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে সমাজের হিংস্রতা নিয়ে। তবে এই সিরিজের সবচেয়ে ভালো দিক হল কোনও অভিনেতার অভিনয় অতিনাটকীয় নয়, ভীষণ ভাবে বাস্তববাদী। যেখানে যতটা প্রয়োজন ততটাই।
ওভারঅল কেমন লাগল?
এই সিরিজের ছ’টা এপিসোড রয়েছে। আর সবটা পর্বেই রয়েছে টান টান উত্তেজনা। বিশেষ করে প্রথম তিনটে পর্বের কথা আলাদা করে বলতে হয়। তাছাড়াও প্রতি পর্বের শেষে এমন কিছু ক্লিফ-হ্যাঙ্গার রয়েছে যা পুরো সিরিজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে উঠতে দেবে না। উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্র নির্ঝরের ম্যাজিকে পুরো গ্রামটা জীবন্ত ভাবে ধরা দিয়েছে। গল্পের বুনোন থেকে ক্যামেরার কাজ, কালার প্যালেট সবটাতেই অভিনবত্বে ছাপ রেখেছেন পরিচালক। আর এই অভিনবত্বই 'ডাইনি'কে অন্যান্য বাংলা সিরিজের থেকে অনেকটা আলাদা করে দিয়েছে। সিরিজের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরও আলাদা ভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবে আবহ তৈরি করেছে তা না বললে অনেক কিছু বলা বাকি থেকে যায়। সব মিলিয়ে বলাই যায় বাংলা সিরিজে এই ধরনের পরিবেশনা খুব একটা দেখা যায় না। এই সিরিজের সূত্র ধরে একেবারে ফ্রেশ একটা গল্প উপহার পেয়েছেন বাংলার দর্শক। তবে সিরিজের কিছু কিছু অংশ দেখে মনে হতে পারে আরও একটু দেখা গেলে হয়তো ভালো হত, মনে হতে পারে কেবল ছটা পর্বে চট করে শেষ না করে আরও একটু দেখাতে পারতেন পরিচালক। তবে গল্পের শেষে আপনাকে দারুণ ভাবে চমক দেবে, সঙ্গে একটু আলোর আশা দেখাবে তা বলাই যায়।