অনিরুদ্ধ ধর
আগের পর্বের মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার আলাপের কথা লিখেছিলাম। কীভাবে আলাপ, কীভাবে এক ঝটকায় ‘আপনি’ থেকে ‘তুই’-এ চলে আসা, কীভাবে অল্প অল্প করে ব্যক্তিগত কথা জানতে পারা— তার কিছুটা আভাস দিয়ে আগের লেখায়। এবার মিঠুনের একটা অন্য দিক নিয়ে লেখার ইচ্ছা হল।
আগের পর্বে লিখেছিলাম, কীভাবে মিঠুনের সঙ্গে আলাপের প্রথম দিনই ওঁর সঙ্গে গাড়িতে সওয়ার হয়ে এক শ্যুটিং স্পট থেকে অন্য শ্যুটিং স্পটে যাত্রা করতে হল। আর সেই ঘটনা বলতে গিয়ে এটাও বলেছিলাম, মিঠুন জানিয়েছিলেন রেখার সঙ্গে ওঁর কথাবার্তা বলার মতো সম্পর্ক নয়। যদিও ছবিতে ওঁরাই নায়ক-নায়িকা। তবু কথা নেই। না থাকার কারণ, অন্য এক নারী।
এই গল্পটায় ঢোকার আগে, আরও পুরনো একটা ঘটনার প্রসঙ্গ তোলা যাক। মিঠুনের থেকেই জেনেছি, মমতা শঙ্করের সঙ্গে ওঁর সম্পর্কের কথা। মমতার একটা সাক্ষাৎকারের দৌলতে অনেকেই জানেন, এক সময়ে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাঁদের। পরে কোনও কারণে সেই বিয়ে ভেঙে যায়। কিন্তু যা ভাঙে না, তা হল পারস্পরিক সম্মান।
বহু বছর পরেও মুম্বইয়ে বসে মিঠুনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পুরনো সম্পর্কের প্রসঙ্গ উঠলে, বার বার শুনেছি মমতা শঙ্করের প্রতি ওঁর ভরসামাখা বন্ধুত্বের কথা। তাহলে সে বিয়ে হল না কেন? আমার ব্যাখ্যা বলে, যে সময়ে এই সম্পর্ক দানা বেঁধেছিল, সেই সময়ে মিঠুন সারা ভারতের পরিচিত নাম নন। মমতা তখন মিঠুনের চেয়ে বেশি পরিচিত এক শিল্পী। ডাকসাইটে সুন্দরী। চেহারা, সৌষ্ঠবে মিঠুন কম যেতেন না। সব মিলিয়ে সেই প্রেমের অনেকটা জুড়েই ছিল অপরিপক্ক দুই মনের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ। ‘ভালোলাগা’-টা ক্রমে বিয়ের কথাবার্তার দিকে এগিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু বেশ জাঁকিয়ে বসা ‘ভালোবাসা’ হয়ে ওঠার আগেই মিঠুন কলকাতা ছাড়েন। আর কে না জানে, ভালোবাসার পথে বড় বাধা ভূগোল!
তাহলে কি ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই ভেঙে যায় মিঠুন আর মমতার সম্পর্ক? অনেকে এ জন্য দায়ী করেন এক নামজাদা নায়িকাকে। ব্যক্তিগত পরিসরে মিঠুনকে এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু কখনও সেই ‘নায়িকা’র নাম উঠে আসেনি। বরং এসেছে অন্য একজনের নাম।
রঞ্জিতা। রঞ্জিতা কৌর। মিঠুনের সঙ্গে পর পর বেশ কিছু ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। ‘সুরক্ষা’, ‘তারানা’, ‘হামসে বড়কর কৌন’, ‘আজত সে মজবুর’, ‘বাজি’, ‘গুনাহোঁ কা দেবতা’— এগুলোর নাম তো এখনই মনে পড়ছে। আরও আছে হয়তো। মিঠুনের সঙ্গে কি রঞ্জিতার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল? এর উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পরিচিত হয়েছি অন্য এক মিঠুনের সঙ্গে।
‘রঞ্জিতা না থাকলে মিঠুন কোনও দিন মিঠুন হতে পারত না রে!’ নব্বইয়ে দশকে বান্দ্রার বাড়িতে বসে যখন মিঠুন চক্রবর্তী এই কথা কলকাতার এক সাংবাদিককে বলছেন, তখন তিনি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক। সে দিন মিঠুনের চোখে যে কৃতজ্ঞতা বোধ দেখেছিলাম, তা এমন কোনও মানুষের চোখেই থাকতে পারে, যিনি অন্তর থেকে সম্পর্কের বিষয়ে সৎ।
- ‘ও একটা কথা, যেখানে শ্যুটিংয়ে যাচ্ছি, ওখানে আমার নায়িকা রেখা।’
- ‘ও মা, তাই নাকি!’
- ‘হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গে কিন্তু আমার টকিং টার্ম নেই।’
- ‘সে কী! কেন?’
- ‘আমার সঙ্গে শ্রী’র একটা সম্পর্ক ছিল জানেন তো?’
- ‘হ্যাঁ, সেটা তো শুনেছি।’
আগের পর্ব থেকে উপরের লেখাগুলি ফিরিয়ে আনলাম। তাহলে গল্পটার ভিতরে পৌঁছে যাওয়া সহজ হবে। রঞ্জিতার কারণে মমতা শঙ্করের সঙ্গে মিঠুনের সম্পর্ক ভেঙেছিল, নাকি তা ছিল ভৌগোলিক দূরত্বের জন্য— সেই আলোচনা অন্য কোনও সাংবাদিককে দেওয়া মিঠুনের অন্য কোনও সাক্ষাৎকার বা ওঁর অটোবায়োগ্রাফির জন্য তোলা থাক। আপাতত দ্রুত গতিতে ঢুকে পড়া যাক মিঠুনের জীবনের সেই রোম্যান্টিক অধ্যায়ে, যেখানে কোনও এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তাঁর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছিলেন রেখা।
(আরও পড়ুন: ভদ্র-শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধি নন, লুম্পেন ক্লাসকে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন বলেই স্টার হন মিঠুন)
প্রথম বার মিঠুনের সাক্ষাৎকার নিতে যখন মুম্বই গেলাম, তখন ওঁকে বাঙালি পোশাক পরিয়ে ছবি তোলার কাণ্ডটার কথা বলেছিলাম। মাড আইল্যান্ডে ওঁর ফার্ম হাউসে সেটি হয়। সেই ফার্ম হাউসেই তখন ছবি-টবি তোলার কাজ শেষ হয়েছে। সোফায় বসে মিঠুন। পাশে আমি। মুখোমুখি রঞ্জনদা (বন্দ্যোপাধ্যায়)।
প্রসঙ্গটা তুলেই ফেললাম।
– তোর সঙ্গে রেখা কথা বলেন না কেন?
– শ্রী’র কারণে।
– ঘটনাটা কী ঘটেছিল?
– দেখ, শ্রী’র সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথাটা তো অনেকেরই জানা। লুকনোর কিছুই নেই। এই মাড আইল্যান্ডের ফার্ম হাউসেই ও কত বার এসেছে, তারও হিসাব নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা টিকল না।
মিঠুন বলতে থাকেন, ‘তোরা জানিস কি না আমি জানি না, এক সময়ে ও (সেই নায়িকা) কোনও ছবির জন্য চুক্তি সই করলে শ্রী চক্রবর্তী নামে করত। মনে মনে আমরা বিবাহিতই ছিলাম। কিন্তু সেই সম্পর্কটা এগোয়নি।’
মনে রাখতে হবে, এটা ১৯৮৮-৮৯ সাল। ওই সময়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের অনেকগুলিতেই এই ঘটনার কথা প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও খুব পরিষ্কার করে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হত না। কীভাবে প্রেম, কেন প্রেম— সব কিছু নিয়ে ফিসফিসানি ছিল পুরো মাত্রায়। এর আগে ১৯৭৯ সালে মিঠুনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল হেলেনা লিউকের। সেই বিয়ে মাস চারেকের বেশি টেকেনি। মিঠুনের নাকি হেলেনার পূর্বতন প্রেমিক জাভেদ খানকে নিয়ে সন্দেহ ছিল। মজার কথা, বিয়ে ভাঙার পরেই হেলেনা নাকি সোজা ফিরেও গিয়েছিলেন জাভেদের কাছে। আর এই সময়েই মিঠুনের জীবনে আসেন যোগিতা বালি। ওই বছরই, মানে ১৯৭৯ সালেই বিয়ে হয় তাঁদের। কারও কারও মত, আসলে মিঠুন তলে তলে আগে থেকেই যোগিতার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই কারণেই হেলেনা তাঁকে ছেড়ে যান। এর কোনটা আগে, কোনটা পরে— তার হিসাব অবশ্য এখন দেওয়া মুশকিল।
যাই হোক, কিন্তু ১৯৭৯ সালে যোগিতা এবং মিঠুনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে শ্রী এলেন কোথা থেকে? বড় প্রশ্ন। মিঠুন কি তাহলে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন? অন্য কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কমই। কী হল তার পরে? সেই সময়কার পত্রপত্রিকার গসিপ কলামগুলিকে সত্যি বলে ধরলে বলতে হয়, মিঠুন তখন যোগিতাকে ছাড়তে পারেননি। সেই প্রেমিকাকে নাকি কথা দিয়েছিলেন বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসবেন, কিন্তু আসেননি। কেন আসেননি? প্রেম, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, ভরসা? নাকি আরও কিছু?
‘বলব। তবে লিখতে পারবি না সেটা।’ প্রায় তিন যুগ আগে করা মিঠুনের অনুরোধ। লেখার নিয়ম আজও নেই।
– সে তো বুঝলাম, কিন্তু রেখার ব্যাপারটা কী?
– শ্রী এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে সোজা রেখার বাড়ি।
– কেন?
– কেন আবার! রেখা তো ওর গডমাদার। সোজা রেখার বাড়ি।
– তার পরে?
– তার পরে আর কী? রেখা নিশ্চয়ই ওকে বোঝালেন।
– কী বোঝালেন?
– কী আবার বোঝাবেন! পুরুষরা ভালোবাসতে জানে না। সব পুরুষই আসলে এক। সবাই ওই লম্বা লোকটার মতো... এই সবই বোঝাবেন।
হাসিতে ফেটে পড়েন মিঠুন। ঘরে আমরা হাসতে থাকি। আমি একটু বেশি। রঞ্জনদা একটু কম। মাস্টারমশাই তো। কিন্তু এই হাসির আড়ালে একটা নাম চাপা পড়ে যায়। মিঠুন-শ্রী-রেখাকে যে গল্পের মুখ্য চরিত্র বলে মনে হয়, আসলে তাঁরা কেউ নন— সেই গল্পের কেন্দ্রে থাকেন অন্য একজন। যোগিতা।
আচ্ছা, এই যে প্রেমিক মিঠুন, নারীদের মধ্যে জনপ্রিয় মিঠুন, হয়তো বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে (মনে মনে যা হয়তো আর একটি বিয়েই) জড়িয়ে পড়া মিঠুনকে কীভাবে গ্রহণ করেছেন যোগিতা? ভালোবাসতে পেরেছেন তাঁকে? গসিপ পত্রিকার কলামে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। যেখানে এসব চুটকি শেষ হয়, সেখানে আমরা ঝাঁপ দিই মানব মনের অতল গভীরে। কার মন? মিঠুনের মন? যোগিতার মন?
‘আমার সব ওর জন্যই।’ বেশ কয়েক বছর বাদে আবার সেই মিঠুন। কৃতজ্ঞ মিঠুন। মুম্বইয়ে রঞ্জিতা কৌর প্রসঙ্গে কথা উঠতে যে কৃতজ্ঞতা বোধ ওঁর চোখে দেখেছিলাম, তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি কৃতজ্ঞতা অবশ্য এবার। কথা হচ্ছিল কলকাতার এক হোটেলে বসে। এই শহরে এলে মিঠুন ওই হোটেলেই উঠতেন। এর কিছু দিন আগে এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন তিনি। এক কন্যা দত্তক নিয়েছেন। ব্যস আবার গসিপওয়ালাদের গুনগুনানি শুরু হয়েছে।
(আরও পড়ুন: ‘সেট থেকে বেরিয়ে যাও…’, জাতীয় পুরস্কার জিতেও শুনতে হয়েছিল মিঠুনকে, কী করেছিলেন?)
‘এ নির্ঘাৎ মিঠুনের ঔরসজাত সন্তান। তাই কায়দা করে ঘুরিয়ে দত্তক নিয়েছে।’ এমন কথা অনেককেই বলতে শুনেছি। কিন্তু সেবার কলকাতার সেই পাঁচ তারা হোটেলে বসে সে কথা বিশ্বাস হয়নি।
স্পষ্ট বাংলায় মিঠুন ফের বললেন, ‘ওর জন্যই আমার সব।’ যাঁকে নিয়ে বলা, তিনিই ঘরেই বসে আছেন, মিটিমিটি হাসছেন। তিনি যোগিতা বালি। বাংলা বুঝছেন কি না জানি না।
‘আমি যে ওকে দত্তক নেব, এমন কথা ভাবিনি। আমাদের কোনও মেয়ে নেই। যোগিতা অনেক দিন ধরেই বলছিল, একটা মেয়ে থাকলে বেশ হত। আমারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হয়নি। কী আর করা যাবে। তার মধ্যে একটা মেয়ে কোথা থেকে এসে হাজির হল জীবনে। যোগিতাই চাইল ওকে দত্তক নিতে। আমি মানা করিনি।’ দূরে দাঁড়িয়ে মিসেস চক্রবর্তী মিটিমিটি হাসেন। বাংলা বুঝলেন কি না জানি না।
মিঠুন চক্রবর্তী এমন এক সময়ের হিরো, যে সময়ে সিলভার স্ক্রিনের তারকাদের জীবনে সাধারণ মানুষের এভাবে আনাগোনা ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আজ যেভাবে তারকাদের প্রতিটা আঙুলের কাঁপনও সাধারণের কাছে পণ্য হয়ে উঠেছে, সেদিন তা কল্পনাও করা যেত না। ফলে তাঁদের জীবনের কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যা, কতটা সাজানো, কতটা রং চড়ানো, কতটা প্রেম, কতটা অপ্রেম— তা বোঝা ছিল দুষ্কর। কিন্তু কখনও মুম্বইয়ে মাড আইল্যান্ডের ফার্ম হাউস, কখনও বান্দ্রার বাড়ি, কখনও কোটি টাকার ক্যারাভ্যান, কখনও দক্ষিণ কলকাতার এক পশ হোটেলে ঘরে বারবার যে মিঠুন চক্রবর্তীর চোখে আমার চোখ পড়েছে, সে মিঠুন সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলাই যায়।
এই মিঠুন ক্যাসানোভা, এই মিঠুন কথা দেয়, এই মিঠুন কখনও কখনও কথা রাখেও না, এই মিঠুন আনাড়ী, এই মিঠুন আ-নারী। তবু যদি কখনও তাকে অফ গার্ড পাও, কখনও সে চকিতে উদাস হয়ে যায়, তখন সে মিঠুন নয়, উত্তর কলকাতার একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গৌরাঙ্গ। তার দু’চোখে তখন শুধুই কৃতজ্ঞতা। তাকে প্রেম বললে প্রেম, অন্য কিছু বললে, অন্য কিছু। সেই প্রেম কার প্রতি? যোগিতা?
মিঠুনের কথা জানি না। গৌরাঙ্গের কথা জানি। তার সব কিছুর জন্যই যোগিতা। বাকি সব চোখের বালি।
(চলবে)
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন)