স্বপ্ন বুনতে আসার গান
কেবল এই অস্থির সময়টুকুর পরিপ্রেক্ষিতে নয়, বহু যুগ ধরে, প্রতিদিন অসংখ্য প্রতিকূলতা জয় করে হাজার হাজার মানুষ হাঁটছেন নগরে, গ্রামে, উপত্যকায়, উপকূলে, কারণ তাঁরা চলা বন্ধ করে দিলে বাড়ির মানুষ গুলো খাবে কী? এমনই একজন মানুষ আমাদের এই ‘কৃষ্ণ’। প্রত্যন্ত হতে মহানগরীতে স্বপ্ন বুনতে আসা ছেলেটা থেকে শুরু করে ট্রেনের ওই ফেরিওয়ালারা, সকল সাধারণ মানুষের রোজকার লড়াইয়ের গান হয়ে বাঁচুক আজকের কৃষ্ণরা।
আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে। গান বাজনার বাড়িতেই আমার জন্ম। আমার বাবা রাজেন্দ্র প্রসাদ হাজারী একজন আদ্যোপান্ত গানের মানুষ। ছোটবেলা থেকে সেই পরিবেশেই বড় হয়েছি। বরাবরই ইচ্ছে ছিল নিজের গান গাইব। হরবোলা আর্টিস্ট হব না। ভালো ক্রিকেট খেলতাম, তাই কলেজ শেষ করে স্পোর্টস কোটায় কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসি। যদিও কাজে এতটুকুও মন ছিল না। প্রথম প্রথম এই শহরে বড় অসহায় লাগত। কাউকে চিনতাম না! তবে একটা জিনিস বারবার মনে হতো, শুধু চাকরি করা নয়, আমার এই শহরে আসার পিছনে ঈশ্বরের অন্য কোনও ইশারা রয়েছে!
সময় লাগলেও সফলতা আসবেই
ধীরে ধীরে কিছু বন্ধু তৈরি হল। পরিচয় হল বিখ্যাত অভিনেতা এবং গায়ক শুভময় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম ওঁর গান। অনেক কিছু শিখেছি শুভদার কাছে, গানের মধ্যে দিয়ে কেমন করে গল্প বলতে হয় সেটা প্রথম জেনেছিলাম শুভদার কাছে। নন্দন চত্বরে যাওয়া শুরু করলাম। ওখানেই আলাপ হল আমার মতো আরও কয়কটা ছেলের সঙ্গে। ওঁরাও আমার মতো এই শহরে পরিযায়ী। কিছুদিনের মধ্যেই গড়ে উঠল বন্ধুত্ব। আমরা চার জনেই শিল্পী হতে চাই। একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চারজন থাকতে শুরু করলাম টলিগঞ্জ পাড়ায়, কারণ টলিউড আমাদের লক্ষ। ততদিনে আমি চাকরিতে জবাব দিয়ে ফেলেছি। আমাদের যৌথ পরিবার, আমি বাড়ির বড় ছেলে, এই বাজারে চাকরি ছেড়েছি জানলে তাণ্ডব লেগে যাবে, তাই বাড়িতে কিছু জানাই নি, শুধু বাবাকে বলেছিলাম। কারণ একমাত্র বাবাই বুঝবেন আমার স্বপ্ন। বলেছিলেন, বাড়ি নিয়ে ভাবতে হবে না, মন দিয়ে গান কম্পোজ করে যাও। সফল হও, আর এদিকটা আমি সামলে নেব। বাবা শুনেছিলেন ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির পলিটিক্সের কথা,তাই সেদিন বলেছিলেন, কাজ পাওয়ার জন্য নিজের সম্মান কখনও বিকিয়ে দিও না। অন্যায়ের সঙ্গে কোনও আপোষ নয়। গানটা যখন সঠিক জানো তখন নিজের প্রতি ভরসা রেখো। সময় লাগলেও সফলতা আসবেই।
লড়াইয়ের মেগা সিরিয়াল
চার বন্ধুর একসঙ্গে থাকা শুরু হল। চলল টলিউডে নিজের জায়গা পাকা করে নেওয়ার লড়াইয়ের মেগা সিরিয়াল। অনেক মজার মজার ঘটনা রয়েছে সেই সময়কার। খুব ফেমস ছিল আমাদের বাড়িটা, সবাই মজা করে বলত ‘অলকায়দা’! আজ এই মুহূর্তে আমার সেই বন্ধুরা টলিউডের প্রথম সারির পরিচালক, অভিনেতা এবং ডান্স কোরিয়োগ্রাফার। কখনও সুযোগ হলে সিনেমা তৈরি করব আমাদের অলকায়দা বাড়ি নিয়ে।
এই যে সময়টার কথা বললাম, তখন আমরা প্রায় কাজ পেতাম না বললেও চলে, খাওয়ার পয়সা, বাড়ি ভারার টাকা জোগাড় করাও খুব চাপের হয়ে যেত। মাঝে মাঝে যে যার বাড়ি চলে যেতাম, কয়েক দিন কিছু ভালো খাওয়াদাওয়া করে আসতাম। তখন খুব অল্প পয়সায় আমরা স্টেজ শো করতাম, টিভি শো, অ্যঙ্কারিং, টেলিফ্লিম, যা পেতাম তাতেই আমরা কাজ করতাম, যাতে বাড়ি ভাড়া, খুব সাধারণ কিছু খাওয়া দাওয়া আর টেলিফোন বিলটা অন্তত দিতে পারি। এই রকমই একটা সময় কৃষ্ণের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা কৃষ্ণ নগর লোকালে।
কৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম দেখা
মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা যাওয়া আসা করতাম বিনা টিকিটে।পয়সা বাঁচাতাম। টিটি এলে এদিক ওদিক লুকোচুরি খেলতাম! কৃষ্ণ নগরে ট্রেন পাল্টাতাম কারণ লোকাল ট্রেনে টিটি ওঠেন না। সেই ট্রেনেই দেখতাম একজন অন্ধ বাঁশিওয়ালাকে। বাঁশি বাজিয়ে ভিক্ষা নয়, বাঁশি বিক্রি করে রোজগার করছেন তিনি। তাঁর বাঁশিতে বাজত বিখ্যাত হিন্দি গানের সুর। এবং তিনি যখন হকারি করতেন তখন কালো চশমায় চোখ ঢাকতেন না, কারণটা অন্য হকারদের থেকে জেনে লোকটার ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। কারণটা হল, কেউ যাতে তাঁর দুর্বলতা দেখে তাঁকে দয়া করে বাঁশি না কেনেন। ইচ্ছে হলে মানুষ এমনিই কিনবেন। আমি ভাষা হারিয়ে ছিলাম ওঁর আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মান বোধ দেখে!
একদিন ট্রেন অনেক লেট ছিল, লোকের কাছে খোঁজ নিয়ে ওই বাঁশিওয়ালা ভদ্রলোকের বাড়ি গেলাম, দেখি একটা ছোট্ট মেয়ে আর এক বুড়ি মা নিয়ে তাঁর একমুঠো সংসার। স্ত্রী মারা গিয়েছেন টিবি রোগে। আগে কারখানায় কাজ করতেন। ধর্মঘটে তাও বন্ধ বহুদিন। কয়েক বছর আগে পক্সে দৃষ্টি শক্তিও হারিয়েছেন। তারপরও লড়ে চলেছেন বাঁচার তাগিদে।সেদিন নিজের অজান্তেই ভিজে গিয়েছিল আমার চোখের কোণ, মনে হয়েছিল আজ ঈশ্বর কৃষ্ণ যদি কোথাও থাকেন তবে এই রকম হাজার হাজার কৃষ্ণের আত্মবিশ্বাসের মধ্যেই তিনি বসত করছেন। কারণ তাঁরাই তাঁদের সংসারের ত্রাণকর্তা। উনি যদি রোজ এই লড়াইটা জিততে পারেন তাহলে আমরা কেন পারব না? এই লড়াইয়ের কাছে আমাদের স্ট্রাগল তো কিছুই না!
নন্দনে বসে বন্ধু ও লেখক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেক্ষণ আড্ডার ছলে আলোচনা করেছিলাম ওই অন্ধ বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে, মনে হয়েছিল এই গল্পটা যেন আমাদের নিজেদের গল্প। সবাইকে জানানোর প্রয়োজন এই লড়াইয়ের কাহিনি। অন্তত কিছু মানুষ তো হতাশা, ডিপ্রেশন ভুলে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাবে। সেই ভাবনা থেকেই সঞ্জয়ের এক অসাধারণ লেখা এই কৃষ্ণ।