তিনি নেই এক বছর। আজ ১৫ নভেম্বর। ঠিক এক বছর আগে আজকের দিনে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন বাংলা ছবির কিংবদন্তি তথা অন্যতম আইকন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিংবদন্তি অভিনেতার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাই আর পাঁচজন বাঙালির মতো মনখারাপ বর্ষীয়ান অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর। পর্দার বাইরেও ব্যক্তিগত জীবনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুব কাছের সম্পর্ক ছিল পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর। কিংবদন্তি অভিনেতার চলে যাওয়ার শোক তাই তাঁর কাছে কাছের বন্ধু হারার শোকের মতোই। হিন্দুস্থান টাইমসকে ফোনের ওপার থেকে তাঁর 'সৌমিত্র দা' সঙ্গে কাটানো নানান অজানা মুহূর্তের কথা তুলে ধরলেন তাঁর 'পিস হেভেন' ছবির সহ অভিনেতা।
স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে পরাণ বলে উঠলেন,' তখন পরিচালক সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর 'পিস হেভেন' ছবির শ্যুটিং চলছে। আমি আর সৌমিত্রদা একসঙ্গে কাজ করছি। এক হোটেলে ছিলাম,পাশাপাশি ঘরে। শ্যুটিং শেষ হলেই দু'জনে গিয়ে জমিয়ে বাবু হয়ে বসতাম হোটেলের বিছানায়। শুরু হাত আড্ডা। কত বিষয়, কত রং। পুরোনো টলিপাড়ার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই কবিতা আবৃত্তি করে উঠতেন সৌমিত্রদা। কী উদাত্ত গলা। মুগ্ধ হয়ে শুধু শুনে যেতাম। অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। সাধারণত আশির চৌকাঠ পেরোলে স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করে। ওঁর ক্ষেত্রে একেবারেই তা হয়নি। একটি উদাহরণ দিলে বুঝবেন। নিজের কেরিয়ারে একবারই মাত্র একটি সিজনের জন্য যাত্রায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মাত্র এক বছরের জন্য বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে অনুষ্ঠান আয়োজকদের সঙ্গে যেতে হাত তাঁকে। তাও সেসব বহু বছর আগের ঘটনা। কয়েক বছর আগে আমি আর সৌমিত্রদা শ্যুটিংয়ের সুবাদেই একটি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি গাড়িতে। রাস্তা খুঁজে পেতেই হিমশিম খাচ্ছে চালক, এমন সময়ে জানলার বাইরে থেকে জায়গাটি জরিপ করে হঠাৎ করে পথ নির্দেশ দিতে শুরু করলেন সৌমিত্রদা! আমরা সবাই তো অবাক। কোনওরকমে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কী করে চিনলেন এ জায়গা? এক গাল হেসে জবাব এল, 'আরে বহু বছর আগে এখানে একবার যাত্রা করতে এসেছিলাম। বেশ চেনা চেনা লাগল। রাস্তাঘাটগুলো ভুলিনি দেখছি, তাই....'
কথার মাঝে সামান্য থেমে, গলা খাঁকরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বরুণবাবুর বন্ধু' ছবির সহ অভিনেতা ফের বলে উঠলেন, 'পিস হেভেন শ্যুটিং শেষে একবার আড্ডা মারছি তখন সৌমিত্রদা কবিতা বলছেন আমি গান গাইছি। সঙ্গে মেপে হুইস্কি পান করছেন। আমি অবশ্য ওই রসে বঞ্চিত। তো তা দেখে ভালোবেসেই গলার স্বরটিকে করুণ করে সৌমিত্রদা বলে উঠতেন, 'ও পরাণ,একটু খাও। একটু খাও না পরাণ'। সেসব শুনে হেসে ফেলতাম। এত ভালোবাসতাম তো তাই সৌমিত্রদার সেকথাও রেখেছিলাম। দু' ঢোঁক খেয়েওছিলাম ওঁর সম্মান রক্ষার্থে'। হাসতে হাসতে আরও বাতলালেন, 'এরপর শুরু করল খুনসুটি। ওরে বাবা! সেসব মোটেই আপনার কাছে ফাঁস করতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন। এই ছিল আমার সৌমিত্রদা!'
এরপর বক্তব্য শেষে জোর গলায় 'প্রলয়' ছবির নায়কের সংযোজন, ' আমি সৌমিত্রদার মৃত্যু অস্বীকার করি!' মন্তব্যের পিছনে তাঁর যুক্তি, 'যাঁদের যাঁদের জীবনে সত্যিকারের ভালোবেসেছি এবং যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন এঁদের মৃত মুখ আমি দেখিনি ইচ্ছে করেই। কারণ বিশ্বাস করি তাঁদের হাসিমুখের স্মৃতিটুকু যদি আমি বুকে আগলে রাখি তাহলে অনেক বেশি জোর পাব মনে। মনে হবে কোথাও বাইরে গেছে তাঁরা, আবার এই এল বলে। এই ব্যাপার আমি আমার মা, স্ত্রীর বিদায়বেলায় আমি যাইনি'।