ঘোষণার দিন থেকেই দর্শকদের মধ্যে চড়ছিল পারদ।একে সত্যজিৎ রায় তার ওপর নেটফ্লিক্স। এই বিশ্ব বিখ্যাত পরিচালকের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁরই লেখা চারটি ছোটগল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি। সিরিজের নাম 'রে'। এভাবেই 'ট্রিবিউট' জানানো হয়েছে বিশ্ব সিনেমার সর্বকালের অন্যতম সেরা পরিচালকের স্মৃতির উদ্দেশে। তবে সারা ভারতে বেশ ভালো ভাবে এই 'রে' গ্রহণ করা হলেও বাংলার মানুষের রায় কিন্তু সেসবের থেকে একটু আলাদাই।
সত্যজিতের লেখা চারটি ছোটগল্প বিপিনবাবুর স্মৃতিভ্রম, বহুরূপী, বারীন ভৌমিকের ব্যারাম এবং স্পটলাইট থেকে ভিত্তি করে যথাক্রমে এই সিরিজের 'ফরগেট মি নট', ' 'বহুরূপীয়া','হাঙ্গামা কিউ হ্যাঁয় বরপা’ এবং 'স্পটলাইট'। সত্যজিতের গল্প নিয়ে ছবি নিয়ে যেহেতু র্যাঙ্কিং হয় না তাই প্রতিটি ছবি ঘিরেই সমান আগ্রহ ছিল দর্শকদের। তবে মুক্তির পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসা শুরু হয়েছে। নানা মুনির নানা মত যাকে বলে। একধারে বর্তমান সময়ে সত্যজিৎ না পড়া মানুষদের যেমন এই সিরিজ বেশ মনঃপুত হয়েছে অন্যদিকে সত্যজিৎ পড়া বাঙালি পাঠকের বিরাট একাংশ রীতিমতো মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে 'রে' দেখার পর। আসলে মুশকিলটা হলো ভাষার কারণে ও সিনেম্যাটিক কারণের দোহাই দিয়ে 'রে'-এর প্রতিটি গল্পের বেশ কিছু অংশ সম্পূর্ণ বদলে ফেলা হয়েছে। টেকনিক্যালি ভাষায় একে হয়তো বলা যায় 'ডিরেক্টর্স লিবার্টি'। কিন্তু তার বাইরেও পর্দার এপারে বসা দর্শকদের কাছে যে আরও কিছু কৈফিয়ত দেওয়া বাকি থেকে যায় পরিচালকের। ঠিক সেই জায়গাতেই প্রশ্ন তুলেছেন সত্যজিৎ ভক্তরা।
মনে রাখতে হবে সত্যজিৎ কিন্তু আদতে এই গল্পগুলো কিশোর ও কিশোরীদের জন্য লিখেছিলেন। প্রায় প্রতিটি গল্পের মধ্যেই প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে রয়েছে মূল্যবোধ এবং নীতিকথা। সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে ' বিট্যুইন দ্য লাইনস'-এ। খানিকটা যেন 'ঈশপস ফেবেলস'-এর মতোই। এবার সেই গল্প বলা হলো বড়দের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই তার রূপ, রঙ, রস, গন্ধ বদলাবে। কিন্তু তার জন্য গল্পের নিউক্লিয়াসে কেন খোঁচা লাগবে? 'পিউরিস্ট' সত্যজিৎ-প্রেমীদের আপত্তির জায়গাটা ঠিক এখানেই। প্রতিটি গল্পকে বর্তমান সময়পোযোগী করার তাগিদে নারীবর্জিত গল্পে একাধিক নারী চরিত্র এবং যৌনতার দৃশ্যে কতখানি প্রয়োজন ছিল উঠেছে সেই প্রশ্নও।কেউ কেউ বলছেন সত্যজিতের গল্পের পাঠক যাঁরা, তাঁদের মোটেই এই সিরিজ ভালো লাগবে না। ওই ব্যক্তি সোজাসুজি জানিয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে তাঁর এই সিরিজ বিলকুল না পসন্দ। এতটাই বাজে লেগেছে যে ফের একবার সত্যজিতের লেখা এই গল্পগুলো পড়ে 'রে'-কে ভুলে যেতে চান তিনি। অন্য এক নেটিজেন জানিয়েছেন সত্যজিতের গল্পকে পর্দায় এত জঘন্যভাবে পর্দায় তিনি এর আগে কখনও দেখেননি।বাঙালি দর্শকদের একাংশের মতে সুস্বাদু ক্ষীর ছোট এবং বড় উভয়ই খেতে পারে। পাত্রও অবশ্যই হবে আলাদা। কিন্তু তাই বলে ক্ষীরের স্বাদ সম্পূর্ণ পাল্টে গেলে সে তো আর ক্ষীর থাকে না। হয়ে যায় অন্য পদ!
তবে হ্যাঁ, তিন পরিচালকের চেষ্টাকেই কুর্নিশ জানিয়েছে দর্শক। এ রাজ্যে বাদ দিলে দেশের অন্যান্য রাজ্যে কিন্তু 'রে' নিয়ে বেশ উছ্বসিত দর্শক। বিশেষ করে মনোজ বাজপেয়ী, গজরাজ রাওয়ের 'মঞ্চে' প্রবেশ করার পর এক নিমিষে গতি দ্রুত হয়েছে এই সিরিজের। সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত 'বহুরূপীয়া'-এর শেষটুকু নিয়েও অকুন্ঠ তারিফ করেছে দর্শকের বিরাট অংশ।
কিন্তু বাঙালি দর্শকের পুরোভাগই যে ভীষণ অখুশি এমনটা মোটেও নয়। 'রে' নিয়ে মিম তৈরির পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসাও শোনা গেছে সিরিজের পরিচালকদের উদ্দেশে। আবার কেউ কেউ তো স্পষ্ট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন তাঁর দেখা নেটফ্লিক্সের সেরা সিরিজ এই 'রে'! যেভাবে প্রতিটি পরিচালক নিজের ছবি তৈরি ঘরানা ভেঙে সম্পূর্ণ অন্যভাবে এই সিরিজের ছবিগুলি পরিচালনা করেছেন তা তারিফের যোগ্য। তাই শেষ পাতে রীতিমতো জোরের সঙ্গে বলাই যায় মুক্তি পাওয়ার মাত্র দু'দিনের মধ্যে সারা দেশে যেভাবে চর্চা চলছে এই সিরিজ ঘিরে তাতে 'রে'-এর সেকেন্ড সিজন যে আসবেই তা বলাই বাহুল্য।