তাঁর জন্মদিন মানে আমাদের বাংলাদেশের একটা বিশেষ দিন। রবীন্দ্রনাথ যতটা ভারতের ততটাই বাংলাদেশের। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তো বটেই, আমাদের দেশের প্রত্যেকটা অনুষ্ঠান, পালা পার্বণ, সব কিছুতেইতো জড়িয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আমার বড় হয়ে ওঠার প্রতিটা ধাপে ধাপে যেন প্রত্যেকবার নতুন করে চিনেছি, জেনেছি গুরুদেবকে। টানটা সেইখান থেকেই। খুব ছোট ছিলাম তখন, ৪-৫ বছর বয়স থেকে পথ চলা শুরু হয় নাচের সাথে।তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানা তারই সঙ্গে সঙ্গে, সেই ছোট্টবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে নিয়ম করে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা আসতাম নাচ শিখতে। বাড়িতে প্রথম থেকে গান বাজনার চর্চা ছিলই। সবাই যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে। যেহেতু বাড়ির সকলে এই গান, বাজনা, নাটক ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তাই আমার ক্ষেত্রে অনেকটাই সহজ হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে শান্তিনিকেতন যেতে পারা।
বাংলাদেশে যাঁর কাছ থেকে প্রথম শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারা সম্বন্ধে জানতে পারি তিনি হলেন আমার গুরু শ্রীমতি শুক্লা সরকার।উনিই কিন্তু আমাকে রবীন্দ্র নৃত্য ও নৃত্যনাট্যের সঙ্গে পরিচয় করান। গুরুমায়ের সান্নিধ্যে দীর্ঘ নয় বছর নাচ শিখেছি। তখন থেকেই রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের হয়ে ঢাকা,বরিশাল, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়ার কুঠিবাড়ি, সিলেট সহ বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করেছি ।তার মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় রানার্সআপ হয়ে চীন ভ্রমণ করেছিলাম বাংলাদেশ থেকে। সেখানে দেখেছি সারা বিশ্বের মানুষ আপ্লুত হয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাঁদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মুগ্ধ করেছিল আমার কিশোর বেলার চেতনাকে। শান্তিনিকেতন আসার ইচ্ছেটাকে যেন কেউ বাড়িয়ে দিল।
গুরুদেবকে নিয়ে পথ চলার আরও একটি অধ্যায় শুরু যখন বাবা মায়ের ইচ্ছেতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছায়ায় নিজেকে তৈরি করার জন্য শান্তিনিকেতনে আসি। ১৯৯৫ সালে আমার দাদা সুবীর চক্রবর্তীর সঙ্গে আমিও শান্তিনিকেতনে পড়তে আসি,। দাদা রবীন্দ্র সঙ্গীত আর রাগ সঙ্গীত নিয়ে, আমি মণিপুরী নাচ এবং কথাকলি নাচ নিয়ে। শান্তিনিকেতনে এসে যেন আমার কাছে সংস্কৃতির দুনিয়ার দরজাটা উনমুক্ত হয়ে গেল। অনেক গুণী মানুষদের কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আমার সকল মাস্টারমশাইরা প্রত্যেকেই একেকজন প্রথিতযশা শিল্পী। অনেক পেয়েছি তাঁদের কাছে। তবে শান্তিনিকেতনে আমার অমূল্য পাওয়া যাঁর কাছে তিনি গুরু জিতেন সিংহ। গুরুদেবের নৃত্যধারাকে যিনি লালন করেছেন নিজের শিল্পীসত্তায়। শান্তিনিকেতন নৃত্যধারা বা স্টাইল আজ সারা দুনিয়াতে সমাদৃত হয়ে ওঠার অনেকটা দায় গুরু জিতেন সিংহে্র ওপর বর্তায়। অসম্ভব ক্রিয়েটিভ একজন মানুষ। ক্ল্যাসিক্যল ধারাকে এইটুকুও বিকৃত না করে সেটাকে যতটা সম্ভব কমার্শিয়ালাইজ করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের মণিপুরী নৃত্যের টানে আজও শান্তিনিকেতনে ছুটে আসে দেশ বিদেশের ছাত্রছাত্রীরা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মণিপুরী নৃত্য আর কথাকলিতে রবীন্দ্র নৃত্য সহজ ও সাবলীল। জিতেনদাও সেই ট্র্যাডিশনকে বজায় রেখেছিলেন তাঁর শেষদিন পর্যন্ত। গুরু শিষ্যের এই পরম্পরা সত্যিই দুর্লভ।
শুরু হলো আরও গভীরে রবীন্দ্র নৃত্যকে অনুভব করা। এ যেন অন্য জগতে প্রবেশ করা।অনেক বড় বড় মানুষের সান্নিধ্য আর আশীর্বাদ । শান্তিনিকেতনে এসে মনে হল এও যেন বাংলাদেশের মতই। সবাই খুব আপন হয়ে গেল। তাছাড়া বাংলাদেশের ছাত্র ছাত্রীরও এখানে অনেক। মনেই হয়নি এটা অন্য কোনও দেশ। প্রত্যেকদিন পড়াশুনার মধ্যে দিয়ে আরও গভীরভাবে শুরু হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানা। বাংলাদেশে যাঁর শুধু অনুভূতি ছিল, সত্যি দর্শন পেলাম এখানে তাঁর।
এবার নিজেকে চেনা শুরু হল অন্যভাবে, ডান্স ড্রামার ক্লাস করতে করতে এমন একটা সময় এল যখন থেকে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছিলাম চণ্ডালিকার প্রকৃতি, শ্যামার উত্তীয়, চিত্রাঙ্গদার কুরূপা বা মদন এই সব চরিত্রের সঙ্গে। নিজেকে পেলাম নতুন করে। আজও সেই চরিত্র গুলোকে আমি যাপন করি, তবেই তো আমার ভেতর জন্ম নেবে রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী নারী চরিত্ররা। আর সেখানেই আমার স্বার্থকতা।
রবীন্দ্র নৃত্যের সঙ্গে কেরালার নিবিড় যোগ। শান্তিনিকেতনে যেহেতু কথাকলি পড়ানো হয়, সেই কারণে কেরালা থেকে অনেক গুরুরাই শান্তিনিকেতন এসেছেন। আমি কর্মসুত্রে কেরালায় থাকাকালীন ওখানকার রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন দেখে মুগ্ধ হয়েছি। একটা মানুষকে প্রায় সারা পৃথিবীর সকল সংস্কৃতি মনস্ক মানুষরা পুজো করেন! এবং তিনিই আমাদের রবীন্দ্রনাথ। যে কোনো দেশ কাল পাত্রের মধ্যে আবধ্য ছিলেন না। রবি ঠাকুর সবার।