‘শেষ বয়সের প্রিয়া' বলেই সম্বোধন করতেন তাঁর শিল্পকলাকে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৃজনশীলতার তাগিদে ষাটোর্ধ্ব বয়েসে ছবি আঁকা শুরু করেন তিনি। তিনি বলেন আমার জীবনের সন্ধ্যায় আমার মন আকার ও রঙ্গে পরিপূর্ণ। তাঁর কথা অনুসারে কেবল চিত্রকলারই একটি মৃত্যুহীন গুণ রয়েছে। অতীতে এবং বর্তমানে তার গুণ অপরিবর্তিত থাকে। ঠিক নোবেল জয়ের মতো তিনিই প্রথম ভারতীয় চিত্র শিল্পী যিনি ভারতবর্ষের বাইরে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী করেছিলেন। রাশিয়া, ইউরোপ, নিউইয়র্ক সহ আরও বহু দেশে। মজার বিষয় হলো তাঁর শিল্পের শিকড় ছিল তাঁর লেখায়, তাঁর পাণ্ডুলিপিতে।
‘'ডুডল’ মানে বাংলায় যাকে হিজিবিজি কাটা বলে। সেটাই করতেন গুরুদেব কবিতার পাণ্ডুলিপিতে। যে সব চাই না সেগুলো কেটে আবার তার থেকে লাইন বের হয়ে অন্য কেটে ফেলা শব্দের সঙ্গে জুড়ে দিতেন, এইভাবেই তৈরি হয়ে যেত বভিন্ন আকার। যেগুলো কখনও পাখির মতো দেখাত, কখনও বা মুখের মুখ বা দানবের আকৃতির কিছু। পাণ্ডুলিপি থেকে বেড়িয়ে যখন তিনি সতন্ত্র ভাবে ছবি আঁকতে শুরু করেন তখন বিভিন্ন রকম বিষয়ের ওপর ছবি তিনি এঁকেছেন। তাঁর ছবির বিষয় হিসেবে এমন কিছু প্রাণী দেখা যায় যার সঙ্গে বাস্তবের কোনোও মিল নেই। যে গুলো স্বপ্ন বা কল্পনাতে তৈরি হয়। প্রথম দিকে কালো কালিতেই ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন, কিন্তু তিনি প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য রঙের ব্যবহার শুরু করেন। তাঁর প্রাকৃতিক দৃশ্যে মানুষের অনুপস্থিতি তাঁদের একটা রহস্যময় চেহারা দেয়। কিছু পোট্রেট যেখানে সেইসব ব্যক্তিদের অভ্যন্তরীণ ভাব যেন ফুটে ওঠে তবে সেখানে মহিলাদের ভিষণ করুন রূপ দেখা যায়, আবার পুরুষদের পোট্রেট গুলোতে কমিক থেকে ট্র্যজিক মুখের বিভিন্ন ভঙ্গি রয়েছে।
তাঁর ল্যন্ডস্কেপ গুলোতে মানুষ না থাকলেও পরবর্তি ছবিতে একাধিক মানুষের দেখা মেলে। ছবি গুলো দেখে কোনও নাটকের দৃশ্য বলে মনে হয়। হয়ত তিনি তাঁর নাটকের মঞ্চস্থ অবস্থার দৃশ্য থেকেই অনুপ্রেরিত হন।
প্রশিক্ষণ কখনও কখনও শিল্পীর কল্পনার স্বাধীনতা ও প্রাণ শক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্বরস্ফুর্ত ভাবেই সরাসরি কাগজে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ছবি রচনা করতেন। এটা তাঁর ছন্দের নিখুত শক্তি।
তিনি কিন্তু থেমে থাকেন নি। তিনি ভারতীয় শিল্পকে পরিবর্তিত করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন। তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ কলাভবন, শান্তিনিকেতন। ১৯১৯ সাল। একটি দেশিয় নৈতিকতার সঙ্গে শিল্পও। তিনি তাঁর ভাইপো গগনেন্দ্র নাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুরকে নতুন শিল্প আন্দলনে উতসাহিত করেন।

নন্দলাল বসু সহ আর্ট স্কুল স্থাপনের জন্য ততকালীন কিছু উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কলাভবন বর্তমানে ভারত এবং বিশ্বে অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্র হিসেবে স্থান পেয়েছে। কারণটা তিনি বিংশ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্বায়ন এনেছিলেন। বিভিন্ন দেশবিদেশের শিল্পকলার পরিচয় ঘটান। রামকিঙ্কর বেজ ঠিক সেই পথ অনুসরণ করে তিনি পাশ্চাত্য শিল্প শৈলী অধ্যায়ন করে নিজের ভাষ্কর্য প্রয়োগ করেন। এবং তা নিয়ে সেই সময় সমালোচনা মূলক হইচই পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ একদিন সকলের অজান্তে সেই কাজ দেখে আসেন। তাঁর স্টোনচিপ, মাটি, সিমেন্ট দিয়ে বানানো স্কাল্পচার দেখে এক বিকেলে বাড়িতে ডাকেন রামকিঙ্করকে। তাঁকে উতসাহিত করেন এই নতুন ভাবনার কাজের জন্য। সেই দীর্ঘ বিকেল শিল্প আলোচনায় মগ্ন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও রামকিঙ্কর।
সেদিনের সন্ধ্যার আলোচনা সার্থক ধারায় আজও সফল শান্তিনিকেতন। এত গুলো বছর পরও কেবল ভারতেই নয়, সারা বিশ্বকে নিজের মোহে মগ্ন করে রেখেছে গুরুদেবের সাধের কলাভবন এবং শান্তিনিকেতন।

