বায়োপিকের জমানায় তথাকথিত রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে কাজ করার সাহস ভূভারতে খুব বেশি পরিচালকের নেই। পান সিং তোমার থেকে কপিল দেব— সবাই উঠে এসেছেন পর্দায়, যেখানে জাতীয়তাবাদ, লড়াই, আদর্শ আবেগের ফ্রেমে ধরা দিয়েছে। পরিচালক অরিন্দম শীল সেখানে সাহস দেখালেন সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর জীবনদর্শন ও জীবনযাপন নিয়ে তৈরি নতুন আঙ্গিকে সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘মহানন্দা’ সিনেমা তৈরি করে। সিনেমাটির মধ্যে রিসার্চ রয়েছে, আদর্শ রয়েছে এবং ইতিহাস তুলে ধরার প্রত্যয় রয়েছে। বিশেষ করে সামনে যখন কোনও নির্বাচন নেই, এই অবস্থায় রাজনৈতিক সিনেমা বানানোর স্পর্ধা কত জনেরই বা আছে!
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিয়োলজি বিভাগের ছাত্রী মহাল সেন পিএইচডি করবেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহানন্দা ভট্টাচার্যকে নিয়ে। এই ক্ষেত্রে তার সঙ্গী অবশ্য বন্ধু (বা তার চেয়েও বেশি) বিহান, যে কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড আবার বাম জমানায় সরকারি শাগরেদও বলা যেতে পারে। শুরুতে একটু অস্বস্তি, সামাজিক অ্যালার্জি থাকলেও মহাল চিনতে পারে সাহিত্যিক মহানন্দা ভট্টাচার্যের মানবিক ও সামাজিক দিকগুলি। এরপর ঘটনা প্রবাহে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বন্ধু বিহান দিনের শেষে সেই পুঁজিবাদের পথিক আর তার জন্য, যত দূর সম্ভব এগোতে পারে। একদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারি সংস্থার জন্য গা-জোয়ারি জমি দখল, আরেক দিকে মহানন্দার লড়াই সাধারণ মানুষকে নিয়ে আর বন্ধু বিহানের মুখোশ খুলে যাওয়া— কী করবে মহাল সেন?
বাকিটা জানতে গেলে অবশ্যই সিনেমাটি দেখতে হবে!
এই সিনেমা জুড়ে উঠে এসেছে কার্ল মার্কস,গণনাট্য আন্দোলন, নবারুণ ভট্টাচার্য, ঝাঁসির রানী, শবর জনজাতি, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, আদিবাসী গ্রাম-বাংলার প্রতি বঞ্চনা, ঋত্বিক ঘটক, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে মেধা পাটেকর, অপারেশন বর্গা, রেশন ব্যবস্থা, তাপসী মালিক, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, পরিবর্তনের ডাক আর অবশ্যই হার্মাদ বাহিনীর কথা। স্পষ্ট করে বলা না হলেও, বুদ্ধিমান খবর-রাখা দর্শক বুঝে নিতে পারবেন পর্দার নাম বদল হওয়া চরিত্রগুলোকে। এখানেই পরিচালক অরিন্দম শীলের মুন্সিয়ানা।
এই সিনেমার প্রাণভোমরা অবশ্যই অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী। নিজেকে অনেকটাই ভেঙেছেন আবার গড়েওছেন এই চরিত্রটির জন্য। তবে বডি ল্যাঙ্গুয়েজের দিক থেকে আরেকটু যত্ন নিলে ভালো হত। মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডুর অনবদ্য প্রস্থেটিক মেকওভারে মনেই হয়নি ছবির মহানন্দা আসলে গার্গী রায়চৌধুরী। পর্দায় বিশেষ ভাবে দাগ কেটেছে মহানন্দার জীবনের প্রথম দিকের ঘটনাগুলোর কথা। মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে বিজন ভট্টাচার্যের কথোপকথন যেন অনায়াসেই ধরা পড়েছে মহানন্দা আর বিধান ভট্টাচার্যের মত বিনিযয়ের মুহূর্তগুলোতে। অর্ণ মুখোপাধ্যায়, ইশা সাহাও নজর কাড়ছেন তাদের সহজ কেমিস্ট্রি নিয়ে। বিক্রম ঘোষের সঙ্গীত পরিকল্পনা যোগ্য সঙ্গত করেছে। আর অবশ্যই সাহানা বাজপেয়ী ও ইমন চক্রবর্তীর গান মিস করে গেলে চলবে না! সাবর্ণী দাসের পোশাক পরিকল্পনা এই সিনেমার সম্পদ।
সরকার ও দল মিলেমিশে গেলে কি হয়, তা পর্দায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরেছেন পরিচালক। বর্তমান সরকারগুলোর জন্যও কি বার্তা থাকল তাহলে? এই সিনেমায় সময়কে সুন্দর ওভারল্যাপ করানো হয়েছে। তাই খলনায়ক, চোলি কা পিছে ক্যায়া হ্যায় এর সঙ্গে বিরসা মুন্ডা, ধানি মুন্ডার রেফারেন্স যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ‘মাটি আমার মা, তাকে ছাড়ছি না’র কথা। সিনেমার চরিত্ররা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময়ে যদি ইংরেজিতে কম কথা বলতেন আর মোবাইল ব্যবহার কম করতেন, তাহলে বোধহয় একটু ভালো হত।
তবে সিনেমাহলগুলোয় ‘আরআরআর’-কে টক্কর দেওয়ার জন্য এসে গিয়েছে বাংলার ‘মহানন্দা’। বাংলা সিনেমাকে বাঁচাতে, বাংলা সিনেমাকে ভালোবেসে অবশ্যই হলে গিয়ে এই ছবি দেখুন!