গৌরব চক্রবর্তী
ঋতুদার জন্মদিনে ওঁকে নিয়ে লিখতে বসে কত কিছুই তো মাথায় আসছে। কিন্তু আবেগের কাছে শব্দরা হার মানছে। ওঁকে নিয়ে যা-ই বলি না কেন, মনে হবে কম বলছি। অভিনয় জগতে আমার হাতেখড়ি ওই মানুষটির হাত ধরেই। অভিনয়ের অ-আ-ক-খ ঋতুদার কাছেই শিখেছি।
ঋতুদা আমার পেশাগত জীবনের কারিগর। ওঁর জন্যই আমি 'গানের ওপারে'র প্রদীপ্ত হয়ে উঠতে পেরেছি। আসলে ওই ধারাবাহিকে আমার অন্য একটি চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু ঋতুদার মনে হয়েছিল, আমাকে প্রদীপ্ত হিসেবে বেশি মানাবে। এর নেপথ্যেও ছোট্ট একটা গল্প আছে।
একদিন নবাগতদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছিলেন ঋতুদা। মিমি, অর্জুন, অনিন্দিতা, ইন্দ্রাশিস— সবাই ছিল সেখানে। ছিলাম আমিও। আমরা যে যার সংলাপ পড়লাম। মন দিয়ে ঋতুদা সবটা শুনলেন। তার পর আমায় ডেকে বললেন, যে চরিত্রে আমাকে ভাবা হয়েছিল, সেটি আমি করব না। আমাকে অভিনয় করতে হবে প্রদীপ্তের চরিত্রে।
প্রথমে মন খারাপ হয়েছিল। ভেবেছিলাম, খুব খারাপ অভিনয় করেছি বলেই হয়তো ঋতুদা ওই চরিত্রটি আমাকে দিলেন না। কিন্তু ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেই যেন সব বদলে গেল! ঋতুদার লেখনীর জোরে দর্শক-মনে জায়গা করে নিল প্রদীপ্ত। একটি চরিত্রকে এত সুন্দর ভাবে গড়ে তোলা যায়? ঋতুদা না থাকলে জানতাম না!
পুপে (মিমি চক্রবর্তী অভিনীত চরিত্র) এবং প্রদীপ্তর প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্য শ্যুট করেছিলেন ঋতুদা স্বয়ং। ওই একটি দৃশ্যেই ওঁর সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়েছিল। শ্যুটের আগে আমাদের সঙ্গে কিছু ক্ষণ কথা বলেছিলেন ঋতুদা। দৃশ্যটি ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তার পর আমরা শট দিই। ঋতুদার সঙ্গে সেই কথোপকথন, তাঁর পরিচালনায় সেই দৃশ্যে অভিনয়— টুকরো টুকরো এই অভিজ্ঞতাগুলোই যেন আমার সম্পদ। যা অভিনেতা হিসেবে আমাকে অনেকটা বদলে দেয়!
সবাইকে আগলে রাখতেন ঋতুদা। অনেক সময় মেক আপ ম্যানকে সরিয়ে নিজের হাতে মিমি-অর্জুনের মেক আপ করতেন। আমি অবাক হয়ে দেখতাম। নিজের বাড়ির আসবাব এনে সেট সাজাতেন। রোজ সকালে ঋতুদার বাড়ি থেকে নিয়ম করে সেটে জিনিসপত্র আসত। প্যাক আপের পর তালিকা মিলিয়ে সেগুলিকে আবার ফেরত পাঠানো হত। ঋতুদা এমনই ছিলেন... বিস্তর সাফল্য পেয়েও কী ভাবে মাটিতে পা রেখে মন দিয়ে কাজ করে যেতে হয়, তা উনিই আমায় শিখিয়ে দিয়ে গেলেন।
'আরেকটি প্রেমের গল্প'-এ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ছবিটি কতটা ভালো লেগেছে, সে কথা কৌশিক (গঙ্গোপাধ্যায়) কাকুকে জানিয়েছিলাম। তার পরেই হঠাৎ একটা ফোন এল। দেখলাম 'ঋতুপর্ণ ঘোষ কলিং'। প্রথমে একটু ঘাবড়ে যাই। ফোনটা তুলতেই প্রশ্ন করেছিলেন, 'ছবিটা তোর ভালো লেগেছে, আমাকে কেন বলিসনি?'
আমি নিজের মতো করে গুছিয়ে একটা উত্তর দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ফোন করে তাঁকে বিব্রত করতে চাইনি। তা শুনে ঋতুদা বলেছিলেন, 'তোর কী মনে হয়েছে আমাকে বলবি। তোর মতামত আমি জানতে চাই ।'
ঋতুদার এই কথাটা যে আমার কী ভালো লেগেছিল! তখন আমি নিছকই নতুন। কিন্তু সেই আমার মতামতকেও উনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কতটা উদার মনের মানুষ হলে এটা করা যায়!
ঋতুদা, তুমি আমার শিক্ষক। আমার অভিনেতা সত্তার কারিগর। জন্মদিনে এই লেখাটুকু থাকুক তোমার জন্য।