'কাহিনী' ছবির 'বব বিশ্বাস' কিংবা ' জগ্গা জাসুস' -এর 'টুটি ফুটি' চরিত্রে অভিনয় করার দৌলতে হিন্দি ছবির দর্শকদের কাছে অন্যতম প্রিয় নাম হয়ে উঠেছে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। আর আপামর বাঙালি ছবিপ্রেমী দর্শকদের প্রিয় তালিকায় তিনি ও তাঁর অভিনয় দুইই রয়েছেন বহু বছর ধরেই। অভিনেতার বাবা প্রয়াত শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় সত্যজিতের নির্দেশনায় একাধিক ছবিতে কাজ করার সুবাদে হয়ে উঠেছিলেন পরিচালকের কাছের মানুষ আর সত্যজিৎ হয়ে উঠেছিলেন শাশ্বতর 'মানিক জেঠু।' রবিবার ২ মে সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর 'মানিক জেঠু' থেকে পরিচালক সত্যজিতের নানান অজানা কথা ও মুহূর্তের কোলাজ ভাগ করে নিলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ফোনের ওপার থেকে শুনলেন রাহুল মজুমদার।
প্রশ্ন : রায় পরিবারের সঙ্গে তো আপনাদের পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল ?
শাশ্বত : নিশ্চয়ই। বাবা যেহেতু ওঁর একাধিক ছবিতে কাজ করেছিলেন তাই সেই সূত্রে রায় পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল যা আজও অটুট। তাই বাইরের মানুষের কাছে উনি ' দ্য সত্যজিৎ রায়' হলেও আমার কাছে উনি ছিলেন 'মানিক জেঠু।'
প্রশ্ন : কেমন ছিলেন ব্যক্তিজীবনে সত্যজিৎ রায় ?
শাশ্বত : আদ্যপান্ত একজন বাঙালি কিন্তু কী অসম্ভব আন্তর্জাতিক! (জোর গলায়) ধুতি পাঞ্জাবি পরার পাশাপাশি ভালোবাসতেন লুচি,ছোলার ডাল খেতে। ওরকম ভরাট গলায় অসম্ভব সুন্দর,পরিপাটি ইংরেজি বলার পাশাপাশি একইভাবে নির্ভুল উচ্চারণে বাংলায় এত সুন্দর করে কথা বলতেন যে অবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর অন্য উপায় থাকতো না। আমি ওঁনার শ্যুটিং ফ্লোরে বার দুয়েক যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। 'গণশত্রু'-এ সেটে। ওরকম অসুস্থ,ভগ্নপ্রায় চেহারায় কী অসম্ভব রাশভারী ব্যক্তিত্ব! আর একটা কথা বলার আছে এই বিষয়ে।
প্রশ্ন : হ্যাঁ, বলুন না।
শাশ্বত : একবার একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছি। উনিও এসেছেন। দেখি খাবার টেবিলে বসে রয়েছেন। প্লেটে ফিশ ফ্রাই নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। পাশে বসে ওঁনার স্ত্রী বিজয়া রায়। মানিক জেঠুকে দেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। জেঠি কথা শুরু করলেন। আমি কথা বলবো কী শুধু মানিক জেঠুকে দেখে যাচ্ছি। হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,' তুমি খুব ভালো তোপসে হতে পারতে!' এই শুনে আমার তো তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। খুব সাহস করে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম,আপনি কি আর ফেলুদা নিয়ে কোনও ছবি বানানোর পরিকল্পনা করবেন ? জবাব এলো,' নাহ! সন্তোষ (দত্ত) চলে গেল। ওঁকে ছাড়া আর ফেলুদা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
প্রশ্ন : শুনেছিলাম আরও একবার নাকি সত্যজিৎবাবুর নির্দেশনায় ফেলুদা ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েও করতে পারেননি ?
শাশ্বত : এক্কেবারে ঠিক শুনেছেন। তখন 'জয় বাবা ফেলুনাথ' এর জন্য অভিনেতার খোঁজ চলছে। আমরা থাকতাম রাজা বসন্ত রায় রোডে। তো শুনলাম আমার বাবাকে একদিন মানিক জেঠু ডেকে পাঠিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। বাবা বাড়িতে এসে হাসিমুখে মাকে জানালেন ওই ছবিতে একটি ছোট্ট ছেলের চরিত্র রয়েছে,নাম 'রুকু'. সেই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমার কথা ভেবেছেন মানিকজেঠু।বাবাকে উনি নিজে ফোন করে বলেছিলেন সে কথা। সেই বুঝে ঠিক হলো পরদিন আমাকে ওঁনার কাছে নিয়ে যাবেন বাবা। এদিকে মায়ের মাথায় তখন অন্য চিন্তা ঘুরছিল। শ্যুটিংয়ের চক্করে আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে কিংবা স্কুল কামাই হবে ভেবে-টেবে মা করলেন কি পরদিনই আমাকে নিয়ে গেলেন পাড়ার সেলুনে। সেলুন থেকে যখন বেরোলাম মাথার চুল তখন কদমফুল। সেদিন শ্যুটিং থেকে বাড়ি ফিরে বাবা তো রেগে আগুন! তবু পরদিন নিয়ে গেলেন মানিক জেঠুর কাছে। আমার ওই অবস্থা দেখে জেঠু তো অবাক। ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, 'আমার ছবির শুটিং যে সামনেই। হাতে তো সময় নেই আমার। ওর চুলের যা অবস্থা তাতে তো বড্ড দেরি হয়ে যাবে।' ব্যাস! ওখানেই ফস্কে গেল সত্যজিৎবাবুর ছবিতে আমার কাজ করার সুযোগ।
প্রশ্ন : আফসোস হয় ?
শাশ্বত : একটু তো হয়ই যে ওঁনার নির্দেশনায় কাজ করার সুযোগ পেলাম না। কিন্তু হয়তো ছোটবেলায় যদি সেটা করতাম বড় হয়ে বাকি এতকিছু নাও পেতে পারতাম। তাই আমি প্রধানত জীবন যেরকমভাবে আমার কাছে হাজির হয় আমি তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি।
প্রশ্ন : সত্যজিৎ রায়ের এমন কোনও ছবি যেখানে আপনার বাবা অভিনয় করেছেন সেই ছবির রিমেকে ওই চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব যদি আপনার কাছে আসে কী করবেন ? রাজি হবেন ?
শাশ্বত : মনে হয় না। রাজি হবো না। আমার মতে 'ক্ল্যাসিক' ব্যাপার সেপারগুলোকে না ছোঁয়াই উচিৎ।
প্রশ্ন : হাইপোথেটিক্যালি একটা প্রশ্ন রাখছি। মনে করুন আপনার মানিক জেঠু বর্তমানে জীবিত। নতুন ছবি তৈরির প্রস্তুতি চালাচ্ছেন। তাঁর নির্দেশনায় সেই ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব পেলেন। কী করবেন?
শাশ্বত : ( উত্তেজিত স্বরে) সেটা আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হতো! আবার বলছি শ্রেষ্ঠ। শুধু বিনি পয়সাতেই সেই কাজ করে থেমে থাকতাম না যদি এমনও হতো ওই ছবিতে একটি মাত্র দৃশ্যে আমাকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়া হতো,আমি তাইই করতাম।
প্রশ্ন : সত্যজিতের ছবির কোনও প্রিয় চরিত্র যা নিজে করতে চাইতেন ভীষণভাবে ?
শাশ্বত : তোপসে! তখন তো ওটাই আমার বয়স। ফেলুদা গোগ্রাসে গিলছি আর মনে মনে নিজেকে ফেলুদার সহকারী হিসেবে কল্পনা করছি।
প্রশ্ন : লেখা সত্যজিৎ রায়ের কোন ব্যাপারটা বেশি প্রিয় ?
শাশ্বত : ফেলুদা! (একমুহূর্ত সময় না নিয়ে) এর সাথে যোগ করুন আমি ওঁনার আঁকার অসম্ভব ভক্ত।
প্রশ্ন : চলতি বছর ওঁনার জন্মশতবার্ষিকী অথচ একদিকে করোনার এই ভয়ানক প্রকোপ এবং অন্যদিকে এই দিনেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল। কী বলবেন ?
শাশ্বত : (একটু থেমে) দেখুন, একটা সরকার গদিতে পাঁচ বছর কিংবা ধরুন আগামী দশ বছর থাকবে কিন্তু সত্যজিৎ রায় কিন্তু থেকে যাবে আমাদের মননে আজীবন।কালজয়ী মানুষেরা এরকমই হয়। এটাই সত্যি। তাই ২ মে এই তারিখটি সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন হিসেবেই থেকে যাবে,ভোটগণনার তারিখ হিসেবে নয় (হাসি।)তাই এই নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে ওঁনার জন্মদিন নিয়ে আমার আলাদা করে আর কিছুই মনে হচ্ছে না।আর হ্যাঁ,বর্তমানে এই করোনা পরিস্থিতি যদি না সৃষ্টি হতো মানিক জেঠুর এই শততমবার্ষিকী উৎসবে পরিণত হতো। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে যা হয়েছিল।
প্রশ্ন : অনেক ধন্যবাদ শাশ্বতদা।
শাশ্বত : থ্যাংক য়ু,অনেকটাই। ভালো থাকবেন ( হাসি)