প্রায় একা হাতে দুই মেয়ে চিত্রাঙ্গদা আর ঋতাভরীকে বড় করেছেন শতরূপা সান্যাল। তাঁর সে লড়াই, অনুপ্রেরণা যোগায় নতুন প্রজন্মকে। মেয়েদের নিয়ে মাঝেমাঝেই মন কেমন করা পোস্ট শেয়ার করে থাকেন পরিচালক। এবার যেমন তাঁর মাধ্যমে উঠে এল, তাংর নিজের শান্তিনিকেতনে পড়ার শখ, কীভাবে তা পূরণ না হওয়ায় পরবর্তীতে বড় মেয়ের মাধ্যমে পূরণ করতে চেয়েছিলেন! কিন্তু যদিও নিজেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। বর্তমানে একটু অসুস্থ, চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছেন শান্তিনিকেতন, আর তাই ফিরে দেখলেন স্মৃতির পাতা।
শতরূপা লিখেছেন, ‘তিতিন আমার বড় মেয়ে। পোষাকি নাম চিত্রাঙ্গদা। ও যখন আমার কোলে এলো, আমি চিত্রাঙ্গদা ছাড়া অন্য কোন নাম ভাবিনি। রবি ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা আমার সেই নাম সন্ধানের প্রেরণা। আর পাঁচজন মায়ের মতন আমিও নানা স্বপ্ন বুনে চলতাম মেয়ের শিক্ষা দীক্ষা ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে। আমার যা করা হয়নি, যা পাওয়া হয়নি, চাইতাম ও যেন সেগুলো করতে পারে।’
এরপরই শতরূপা লিখেছেন তাঁর ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করার। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় একবার তাঁকে বিশ্বভারতীতে ভর্তির চেষ্টাও হয়। যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনিও কলকাতার স্কুল থেকে লেখাপড়া শেষ করলেন, বটানি পড়লেন, ভেটেরিনারি হলেন। যদিও তারপর শিল্পের আঙিনাতেই পা রাখেন।
ঋতাভরীর মা আরও লিখলেন, ‘তিতিনের যখন সাত বছর বয়স, ওদের দুই বোনকে বুকে করে আমি চিরকালের জন্য নিজের হাতে গড়া সংসার ছেড়ে চলে এলাম মা বাবার কাছে। তখন কাজ খুঁজছি, যে কোনো একটা চাকরি, যাতে মেয়ে দুটোকে মানুষ করতে পারি । আমার সেই গোপন পুরনো ইচ্ছেটা মনের মধ্যে ভেসে উঠল । তিতিন যদি আমার সেই শান্তিনিকেতনে পড়ার ইচ্ছেটা সাকার করে!’
এরপর একদিন ফর্মও আনেন শতরূপা। মেয়েকে নিয়ে বোলপুরে যান। পরীক্ষাও দেয় চিত্রাঙ্গদা। ছোট্ট তিতিন (এই নামেই বড় মেয়েকে ডাকেন শতরূপা) তখনও বোঝেনি অবশ্য, মা তাঁকে এখানে হোস্টেলে রেখে পড়ানোর প্ল্যান করছে। পরীক্ষা দেওয়া শেষে মা-মেয়ে মিলে ভূবনডাঙার ছোট ছোট দোকানগুলো ঘুরে মাটির পুতুল কেনে। চেনাজানা সকলের জন্য উপহর কেনেন চিত্রঙ্গদাও। এরপর মা-মেয়ে চলে আসে পূর্বপল্লীর গেস্ট হাউসের ঘরে। রাতে মেয়েকে কোলের কাছে রেখে মন খারাপ শতরূপা। মায়ের মন তো, মেয়েকে ছেড়া যাওয়ার কথা ভাবতেই একরাশ বিষাদ এসে জড়ো হয়। যার স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন, ‘তিতিনের নিশ্চিন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে মনে হল- মানুষ এত নিশ্চিন্ত হতে পারে একমাত্র তার মায়ের কাছেই! আমি ঠিক করলাম, চুলোয় যাক আমার সযত্নলালিত ছোটবেলার স্বপ্ন! মেয়ে আমার , আমার কাছে থেকেই পড়াশুনো করবে। যদি ওর শিল্পী হওয়ার হয়, মায়ের কাছে থেকেই শিল্পী হয়ে উঠবে!’
বর্তমানে চিত্রাঙ্গদা আর ঋতাভরী, দুজনেই বিনোদন জগতে পরিচিতি গড়েছে। নিজের সংসারও পেতেছে বড় বোন। বিয়ে করেছে বছর দুই আগে। কিন্তু মায়ের দিকে থাকে কড়া নজর। কাজের জন্য বাইরে বাইরে থাকলেও, ঋতাভরীও এর অন্যথা করেন না।
শতরূপা তাঁর লেখার শেষে জুড়লেন, ‘আজ আমার শরীর তেমন ভালো নয় বলে মেয়ে আমার ব্যাগটা পর্যন্ত বইতে দিলনা। কাশি, গলা ভাঙা, চোখ দুটো লাল। কিছু একটা সমস্যা তো হয়েছে বটে। কলকাতার বাতাসের দূষণ এর জন্য অনেকটাই দায়ী । শান্তিনিকেতন আমার বড় প্রিয়। এখানে এলে আমি ভালো থাকি। আমি যাতে ভালো থাকি, সেদিকে দুই মেয়েরই দৃষ্টি রয়েছে সদাসর্বদা। আজ তো তিতিন আর আমি সহযাত্রী। পলিন (ঋতাভরীর ডাক নাম) তো শহরের বাইরে। এখন তিতিনই যেন মা আর আমিই যেন তিতিন! পারলে দু হাত দিয়ে আগলে রাখে! আজ মনে পড়ছিল অনেক কথা। অনেক অনেক কথা। যা হয়নি, যা পাইনি তা হয়তো অনেক। কিন্তু যা পেয়েছি, যা হয়েছে, তাও তো কম নয় গো!’