বাংলা নিউজ > বায়োস্কোপ > ‘অভিযান’-এ মুগ্ধ, শুনেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিল সৌমিত্র! অকপট শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

‘অভিযান’-এ মুগ্ধ, শুনেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিল সৌমিত্র! অকপট শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁদের বন্ধুত্বের নানান অজানা গল্প জানালেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।

'এক বছর হয়ে গেল সৌমিত্র নেই। ভাবা যায়! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের ঘটনা। এতটাই টাটকা আমার কাছে স্মৃতিটা'। কথা শুরু করার শুরুতেই বলে উঠলেন কিংবদন্তি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আনমনে বলে উঠলেন, 'স্বাস্থ্য তো ভালোই ছিল। আশি পেরিয়ে গড়পড়তা মানুষ যেমন থাকে তার থেকে ভালো। শুধু করোনাটা যদি না হত....করোনা হয়েই যত গন্ডগোল হয়ে গেল। আর এই করোনাটা হল একটিমাত্র কারণে। ওই ওরকম পরিস্থিতিতেই ফের কাজ করা শুরু করে দিয়েছিল ও। বড্ড বেশি নিজেকে এক্সপোজ করে ফেলল ওই সময়ে। কাজপাগল মানুষ ছিল কী না...সেসব না হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও আজ আমাদের মধ্যে থাকত!'

শীর্ষেন্দুবাবু জানালেন তাঁর থেকে ১১ মাসের বড় সৌমিত্র এতটাই জীবন্ত ছিলেন, প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা ছিলেন যে প্রতিবার তাঁকে দেখে মুগ্ধ হতেন 'দূরবীন' এর স্রষ্টা। 'একবার আমি আর সৌমিত্র বাংলাদেশ গেছিলাম। একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েই গেছিলাম। একই হোটেলে উঠেছিলাম। কত গল্প, কত আড্ডা'। কথায় কথায় জানা গেল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রায় ষাট বছরের বন্ধুত্বের সময় পার করে এসেছিলেন 'গোঁসাইবাগানের ভূত' এর লেখক। আরও জানা গেল, ষাটের দশকের গোড়ায় সৌমিত্রর সঙ্গে আলাপ তাঁর। তখনও সত্যজিতের 'অভিযান' মুক্তি পায়নি। সেই সময়ে কলেজ স্ট্রিটের আশেপাশে একটি বাড়িতে ঘর ভাড়া করে থাকতেন শীর্ষেন্দুবাবু। আর প্রায় প্রতিদিন সকালে 'ফেলুদা'-র সঙ্গে কফি হাউজে ঘন্টা দেড়েক আড্ডা দিতেন। কফির কাপের সঙ্গে চলত আড্ডার তুফান। শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সিনেমা এবং বিশ্বসাহিত্য। 

শীর্ষেন্দুবাবুর কথায়, 'তখন কালীঘাটের ওরিয়েন্টাল স্কুলে মাস্টারি করতাম। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১১ তা অবধি প্রতিদিন সকালে কফি হাউজে আমি আর সৌমিত্র আড্ডা জমাতাম।কফি হাউজ ছিল আমার বৈঠখানার মতো। তারপর আড্ডা শেষে আমি ছুটতাম ৩২ নম্বর বাস ধরবার জন্য আর ও বেরিয়ে পড়ত শ্যুটিংয়ে। তখন ও সাউথ ক্যালকাটা থেকে নিজের অ্যাম্বাসেডর চালিয়ে আসত রোজ'।

'অভিযান' দেখে দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলেন 'মানবজমিন' এর লেখক। কফি হাউজের চেয়ারে জুত করে বসে সেকথা সৌমিত্রবাবুকে বলতেই ভারি খুশি হয়েছিলেন তিনি। লোকজন ভরা কফি হাউজের মধ্যেই উঁচু গলায় হেসে প্রায় জড়িয়েই ধরিয়েছিলেন লেখককে। এরপর বিয়ে করলেন শীর্ষেন্দুবাবু। শুরু হল জীবন সংগ্রাম। সৌমিত্রর হাতে তখন আসতে শুরু করেছে পরপর সব ছবি। আড্ডা এবং যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। এরপর প্রায় কুড়ি বছরের। তারপর ফের যোগাযোগ ও আড্ডা মাঝেমধ্যে জমে উঠত এই দুই পুরোনো বন্ধুর মধ্যে। তবে দূরত্ব যে কখনওই বন্ধুত্বে পাঁচিল তুলে দাঁড়ায়নি তা বললেন শীর্ষেন্দুবাবু।

 'অনেকদিন সৌমিত্র সঙ্গে যোগাযোগ নেই। এমন সময় আমার লেখা থেকে 'পাতালঘর' ছবি তৈরি হল। প্রিমিয়ার শো-তে আমন্ত্রণ পেয়ে হাজির হয়েছিল। ওই ছবিতে সৌমিত্রও ছিল। হলের মধ্যে আমাকে ডেকে আমার নাম ধরে সেই পিছন থেকে বাঁজখাই চিৎকার। প্রায় ছুটে এল। বলল, যাবে না। শো শেষে আড্ডা মারব। খাব একসঙ্গে। তাই হল। তারপর এই বেশ কয়েক বছর আগে 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি' নিয়ে যখন ছবি তৈরি হল, সেই শিবির প্রচারে একটি ফেসবুক লাইভের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমার বাড়িতেই হাজির হয়েছিল সৌমিত্র। একসঙ্গে করলাম গল্প। আমার একটা কাজ থাকায় বেরিয়ে গেছিলাম। সৌমিত্র কিন্তু বাড়ি থেকে যায়নি। আমার ছেলে মেয়ে, স্ত্রীর সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মেরেছিল অনেকক্ষণ। পেট ভরে খেয়েও গেছিল'।

বক্তব্য শেষে 'যাও পাখি' লেখকের সংযোজন, ' আমার মনে হয় ও তো সাহিত্য জগতেরই মানুষ ছিল। কবিতা লিখতে কী ভালোবাসত। আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে কী দারুণ পড়াশোনা ছিল ওঁর যে ভাবা যায় না। বিশ্বসাহিত্য নিয়েও। কী দারুণ সুনীল-শক্তির কবিতা আবৃত্তি করত আর সঙ্গে ওরকম তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি। জানেন, মনটা ভারি খারাপ হয়ে যায় ওঁকে আর দেখতে পাব না ভাবলে। ওই গলার স্বর শুনতে পাব না। আড্ডাটা....নাহ ওরকম আড্ডা আর কারোর সঙ্গেই হবে না!'

বন্ধ করুন