মঙ্গলবার ২রা নভেম্বর ৮৬ তে পা দিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এইমুহূর্তে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি বললে পাঠকমহলেরর তরফে যে কোনও আপত্তি আসবে না সে কথা হলফ করেই বলা যায়। বেশ দেরি করেই লেখক জীবন শুরু তাঁর। যদিও সাহিত্য চর্চা ছিল ছোট থেকেই। তাই তো 'ঘুণপোকা' প্রকাশিত হওয়ার পরপরই নড়েচড়ে বসেছিল বাংলার সাহিত্যমহল। বোঝা গেছিল, খাতায় কলমে প্রথম উপন্যাস হলেও জাত লেখক ছাড়া এ জাতীয় রচনা সম্ভব নয়।সবরকম পাঠকদের মধ্যে সে উপন্যাস দারুণ সাড়া জাগাতে না পারলেও একটু বিদগ্ধ, উচ্চাঙ্গ পাঠকশ্রেণীর কাছে দারুণভাবে গৃহীত হয়েছিল 'ঘুণপোকা' উপন্যাস।

খ্যাতির মধ্যগগনে থেকেও নাম, যশ, অর্থ কোনওদিনই প্রলুব্ধ করেনি বাঙালির এই প্রিয় লেখককে। মধ্যে আশি পেরিয়েও তাই সামান্য সব্জি বা একটু দুধ-রুটি পেলেই খুশি তিনি। জন্মদিনেও এই নিয়মের খুব একটা হেরফের হয় না 'দূরবীন'-এর স্রষ্টার। তবে এদিন নিয়ম করে প্রতি বছর ছোটবেলার কথা বড্ড মনে পড়ে তাঁর। মনে পড়ে প্রয়াত দিদির কথা। সঙ্গে মায়ের হাতে শীতের প্রথম গুড়ের পায়েস। বহু বছর আগে সেইসব জন্মদিন পেরিয়ে এলেও আজও তাঁর ভিতরে কোথাও যেন একলা চুপটি করে বসে সেই ছোট্ট ছেলেটি। ফোনের ওপার থেকে জন্মদিনে নানা রঙের গল্প নিয়ে স্মৃতিমেদুর হলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
জন্মদিন পালনের প্রসঙ্গে কথা উঠতেই শীর্ষেন্দুবাবু বলে উঠলেন, 'চারপাশে যা মনখারাপের পরিস্থিতি তাতে আর জন্মদিন নিয়ে দারুণ উৎসাহ বাকি নেই। তবে প্রতিবার এই দিনে ছোটবেলার কথা বড্ড মনে পড়ে। মা নিজের হাতে পায়েস রাঁধত। সেই গন্ধ, স্বাদ যেন আজও লেগে মুখে। সেদিন ভালো মন্দ রান্না হত বাড়িতে। খুব পেটুক ছিলাম, চেটেপুটে সব খেতাম। তখন অবশ্য মাছ -মাংস সব খেতাম। তারপর তো গত পঞ্চাশ বছরে আর সেসব খাইনি। ছেড়ে দিয়েছি। আর...আর জন্মদিনে একটা করে নতুন জামা পেতাম। কী খুশি যে হতাম। আমাদের তখন অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না তখন। বাবা রেখে চাকরি করলেও অসম্ভব সৎ ছিলেন। একটি টাকাও ঘুষ নিতেন না। তাই ওই একটি জামা পাওয়াই বিরাট ব্যাপার ছিল। মনে পড়ে আমার জন্মদিন নিয়ে দিদি খুব উৎসাহী থাকত। বাবার মনে যে পুত্রস্নেহ ছিলাম তা দিব্যি টের পেতাম কিন্তু তা নিয়ে কখনও সোচ্চার ছিলেন না তিনি। একটা গাম্ভীর্য ঘিরে থাকত ওঁকে। জন্মদিনের দিন ওঁকে প্রণাম করতাম, উনি দু'হাত মাথায় রেখে আশীর্বাদ করতেন। এটুকুই। সামান্য দু'একটি কথা বলতেন। মাথা নাড়িয়ে শুনতাম'।
সামান্য থেমে শিশুর মতো হাসতে হাসতে লেখক ফের বলে উঠলেন, 'আর জানেন তো, বোধবুদ্ধি হওয়ার পরে জন্মদিন নিয়ে আমার কোনওদিন তেমন একটা উৎসাহ নেই। কোথায় বয়স বেড়ে যাচ্ছে তা নিয়ে মনখারাপ করব তা না সব আনন্দ করতে হবে। অবাক ব্যাপার!' সঙ্গে জানালেন এদিন বাড়িতে তাঁর দুই ছেলে মেয়ে ঘরোয়াভাবে পালন করবে এই দিনটি। চলতি বছরেই স্ত্রী গত হয়েছে তাঁর এই দিনে সামান্য হলেও মনটা বিষণ্ন হয়ে রয়েছে কোথাও। অনেক প্রকাশক, ভক্তেরা এদিনটি মহাসমারোহে পালন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেসব প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছেন তিনি। কেন? জবাব দিলেন 'পাতালঘর' এর লেখক নিজেই, 'মানুষ কষ্ট পাচ্ছে চারপাশে, করোনা পরিস্থিতি এখনও ঠিক হয়নি। স্রেফ এই করোনার কারণে কত মানুষ এখনও তাঁদের ক্ষতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন আর আমি সেসবের মধ্যে আনন্দ করব? ভাবলেই মনটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে'।
কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। শরীর আগের থেকে এখন অনেকটাই ভালো। নতুন একটি উপন্যাস লেখার প্লট মাথায় ঘুরছে তাঁর, জানা গেল তাও। আর 'বার্থ ডে রেজোলিউশন'? এক গাল হেসে লেখকের সাফ জবাব, 'জীবনে এত কিছু পেয়েছি না চাইতেই যে আমার চাওয়ার আর কিছুই নেই। সেসব না পেলেও আমার চলত। তবু পেয়েছি। বিশেষ করে অসংখ্য পাঠকের ভালোবাসা, আশীর্বাদ। বাকি জীবনটা তাতেই দিব্যি কেটে যাবে'।