সুধীর দত্ত
সমাজকল্যাণ দফতরে যখন কর্মরত ছিলাম, তখন ভবঘুরে মেলা নামের একটি মেলা হত প্রতি বছর। প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রতি বছরই মেলাতে অংশ নিতেন। সেই সূত্রে বহুদিন ধরেই প্রতুলবাবুকে চিনি। সুরের মূর্ছনায় সবাইকে মুগ্ধ করে দিতেন। ভবঘুরেরাও মুগ্ধ হয়ে শুনতেন ওঁর গান। বছর দুয়েক আগে একটি অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগত আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। দরাজ গলায় গান গেয়েছিলেন ওই দিন। আজও ওই সন্ধ্যাটি স্বপ্নের মতো মনে হয়। কবিতায় সুরারোপ করে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতুলবাবুর খ্যাতি সর্বজনবিদিত। আমার ‘হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’ কাব্যগ্রন্থের সূচনায় একটি মহাকাব্যিক স্তব (বা বন্দনা) রয়েছে। সেই সন্ধেয় ওই স্তব অসামান্য সুরারোপে গাইলেন তিনি। কন্ঠের গাম্ভীর্যে ও সুরধ্বনিতে মায়াময় আবহ নির্মিত হল।
আত্মশ্লাঘা আমার পছন্দ নয়, তবু অগ্রজ প্রতুলবাবুর একটি প্রেরণাসম্ভব উচ্চারণ আজও হৃদয় ছেঁয়ে রয়েছে। সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে বলেছিলেন, ‘সুধীরবাবু, আপনার কবিতা তো আগে সেভাবে পড়িনি। কিন্তু বাংলায় যে এমন মহাকাব্যিক বিস্তার, ভাষা ও গাম্ভীর্যে কবিতা লেখা হচ্ছে, তা অকল্পনীয়!’
আরও পড়ুন - ‘এই শহর তোমার এখনও ভালো লাগে, প্রতুলদা?’, চমকে উঠি স্মৃতির মাঝে হাতড়াতে গিয়ে
প্রতুল মুখোপাধ্যায় একদিকে যেমন ছিলেন স্পষ্টবাদী, তেমনই আরেকদিকে শিল্পের খুঁটিনাটির প্রতি সতর্ক। আমার কাব্যগ্রন্থের স্তবটি সুরারোপ করে গাওয়ার পর নিজেই এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কবিতার অর্থ কি একটুআধটু ধরতে পেরেছি?’ স্বীকার না করে উপায় ছিল না — ‘একটুআধটু নয়, একশোভাগ ধরতে পেরেছেন!’
আমার বিশ্বাস, অত বড় মাপের শিল্পী বলেই বিষয়টি সম্ভব হয়েছিল, হৃদয়স্পর্শী তাঁর ওই সুরারোপ। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রতিভা নানা কারণেই বিরল, অনন্য। তাঁর মতো যন্ত্রসঙ্গীত ছাড়াই খালি কণ্ঠে গান গেয়ে মায়াময় আবহ তৈরির ক্ষমতা খুব গায়ক-গায়িকার রয়েছে। এমন প্রতিভাকে আমরা যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। যতটা তাঁর প্রাপ্য ছিল, ততটা তিনি পাননি।
আরও পড়ুন - Pratul Mukherjee: না ফেরার দেশে সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়
অনুষ্ঠানের আরও দু-একটি স্মৃতি ভিড় করে আসছে। ইচ্ছে ছিল, কবিতাটির কিছু অংশ তাঁর উচ্চারণে ধরে রাখার। এই প্রস্তাবে প্রতুলবাবু স্বয়ং সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের সম্পর্কে আমি বরাবর উদাসীন। ফলে শেষমেশ হয়ে উঠল না। বছর দুই আগে আক্ষরিক অর্থেই একটি মহাকাব্য লেখার কাজ শুরু করেছিলাম। আমার কবিতা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করায়, তাঁকে সে কথা জানালাম। তিনিও সানন্দে শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। আজ ৯৫ প্রবাহে প্রায় ৯০০০ লাইনের ওই মহাকাব্য লেখা শেষের মুখে। কিন্তু শোনানোর আগেই তিনি অন্য লোকের অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাত্রী হলেন আমার অবশিষ্ট জীবনে এক আক্ষেপ যুক্ত করে।
(অনুলিখন - সংকেত ধর)