তারকা হলেও তিনি মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ, মানসিকতা নিয়েই বড় হয়েছেন। ইনি আর কেউ নন, অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। বাবা সন্তু মুখোপাধ্যায় ও মা গোপা মুখোপাধ্যায়, দুজনকেই বহু বছর হল হারিয়েছেন স্বস্তিকা, তবে তাঁদের সঙ্গে অভিনেত্রীর আত্মার বন্ধন আজও দৃঢ়। প্রায়ই বাবা-মায়ের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে দেখা যায় স্বস্তিকাকে। তাঁদের ব্যবহার করা ছোট্ট ছোট্ট জিনিস ছুঁয়ে আবেগে ভাসেন তিনি। সম্প্রতি মা গোপা মুখোপাধ্যায়ের ব্যবহার করা ছোট্ট একটা জিনিসকে বিদায় দিতে গিয়েও মন খারাপ হল স্বস্তিকার। অনুরাগীদের সঙ্গেই ভাগ করে নিলেন নিজের সেই খারাপ লাগার কথা।
কিন্তু কাকে বিদায় জানালেন স্বস্তিকা?
অভিনেত্রী লিখেছেন তাঁর বাড়ির পুরনো মাইক্রোওভেনের কথা। পুরনো সেই মেশিনের ছবি শেয়ার করে স্বস্তিকা লিখেছেন, ‘যখনই কিছু মনে হয়, তখনই লিখে ফেলা ভালো, পরে যদি মনে হওয়াগুলো হারিয়ে যায়…। একটা ইলেকট্রিক যন্ত্রের প্রতি যে এতটা ভালোবাসা লেগে আছে, একটা যন্ত্র খারাপ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে যে মন খারাপের এমন একটা সংযোগ আছে, তাতে যে গলা বন্ধ হয়ে কান্না উঠে আসতে পারে তা আগে জানা ছিল না।’
স্বস্তিকার কথায়, ‘সিনেমার পর্দায় কোন চরিত্রের এমনটা হলে নয় তা নিয়ে কটাক্ষ করতাম, হয়তো ঠিক আমি করতাম না, দর্শকের এক অংশ করত বা ভাবতো সেই চরিত্রের মন খারাপ এর অসুখ আছে। তা আমারও আছে, সব কিছুর জন্য এত প্রবল ভাবে অনুভূতি থেকে যাওয়াটা যন্ত্রনার। সিনেমায় বোধগম্য না হলেও নিজের সঙ্গে ঘটল বলে হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে যে এমনটাও ঘটে। আমার বাড়ির মাইক্রোভেনটার আয়ু শেষ হলো। ওর বয়স আমার মেয়ের চেয়েও বেশি।’
স্বস্তিকা আরও লেখেন, ‘বাড়িতে বিয়ের ম্যারাপ বাঁধা হলে যেমন অনেক নতুন জিনিস কেনা হয়, ১৯৯৮ সালে ও নতুন হয়ে আমাদের কাছে এলো। তারপর জীবন চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। বিপিএল Sanyo কোম্পানি উঠে গেলো, সম্পর্ক চুকে গেল, আমি মা হলাম, মাকে হারালাম, বাড়fতে সাদা কাপড় জড়ানো শ্রাদ্ধের ম্যারাপ বাঁধা হল, জীবনের কত শত ঝড় ঝাপটা পেরোলাম, নাম হলো, কত কেউ, কত কিছু এলো গেল, মাইক্রোভেনটা রয়ে গেল। As if life had bestowed upon it the task of witnessing the tests of time. ও আমার অতি সাধারণ তবু অসাধারণ জীবনে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে থাকার দায়িত্ব নিল।’
আরও পড়ুন-জটিল রোগে আক্রান্ত! যখন তখন অজ্ঞান হয়ে যান, খিঁচুনি ধরে, ঠিক কী হয়েছে ফতিমা সানা শেখের?
আরও পড়ুন-ছুটবে হাসির ফোয়ারা, আসছে অক্ষয়-গোবিন্দা-পরেশ রাওয়ালের ‘ভাগাম ভাগ ২’
অভিনেত্রী ফের লেখেন, ‘গত এক বছরে ও নানান ভাবে জানান দিয়েছে যে ওর চলে যাওয়ার সময় আসন্ন, তাও আমি সব কিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি ওকে আটকে রাখার। বারংবার ভেবেছি, আহারে মা কত উৎসাহ নিয়ে ওকে বাড়ি এনেছিল, কত রকম নতুন পদ্ধতিতে রান্না করে খাওয়াত, চারবেলা আর ঘামতে ঘামতে গ্যাস এ খাবার গরম করতে হবেনা - এই নিয়ে মা যতটা উৎফুল্ল ছিল, কোথাও যেন এই মেশিনটা মায়ের সব অনুভূতিকে নিজের মধ্যে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সেই সময় একটা মাইক্রোভেন থাকা মানে আজকের দিনে অ্যাটমোস্ফিয়ারে ফ্ল্যাট থাকা।'
ফের লেখেন, 'আরও মনে হলো -মানির জন্মের আগে থেকে ও আছে, ওর সামনে ডাইনিং টেবিলে বসে জল-খাবার খেয়ে আমার ওয়াটার ব্রেক হয়েছিল, মানি তখনও আমার পেটে, তারপর সন্তান হলো, সে বাড়ি এলো, বড় হলো, মানির ছোটবেলাটাও যেন ওর সঙ্গে অতঃপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছে। রাতের বেলা খিটখিট করতে করতে বাবার খাবার গরম করাটাও ওর কাছেই আটকে আছে। কত স্মৃতি - বিস্মৃতি। ভাবতে বসলে ভাবার অন্ত নাই। জীবনের ২৬ টা বছরের সাক্ষী এই মাইক্রোভেন।'
মাইক্রোওভেনের কথা বলতে গিয়ে নিজের বাড়ির কাজের লোকের কথা টেনে স্বস্তিকা লেখেন, 'ও আর ডাইনিং রুমের পাশের টেবিলটায় থাকবে না, অন্য কেউ, নতুন কেউ এসে ওর জায়গাটা নিয়ে নেবে ভেবে চোখে জল এলো। মাসি খুব গজগজ করাতে বললাম, দাঁড়াও না ঠিক সারিয়ে নেব। তাতে মাসি আরও গজগজ করে বলল, ও আর সারবে না ওকে বাদ দাও। আজকে দোকানে গিয়ে একটা নতুন কিনে আনবে, আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে।
মাসির কথা মতন ওকে নামিয়ে মাটিতে রাখলাম, নতুন এর জায়গা করতে, ২/৩ দিন ধরে ওই ভাবেই মাটিতে বসে ও যাওয়ার অপেক্ষা করছিল। বাড়ির ভেতর নড়ছি চড়ছি আর ভাবছি - তবু তো আছে। মা বাবা চলে যাওয়ার পর অনেক শুভানুধ্যায়ীরা বলে ছিলেন - অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো, ঈশ্বরের অনেক কৃপা বেশি যন্ত্রণা পেতে হয়নি, চলে গেছে, এরকম মৃত্যু ভাগ্যের কথা। মা কে নিয়ে ডক্টররা বলেছিলেন, উনি থাকলে কিন্তু ভেজিটেবল হয়ে পরে থাকবেন, এর চেয়ে না থাকাই ভালো, আপনারা মন শক্ত করে চলে যেতে দিন। তখনও ভেবেছিলাম, আজও ভাবি, তবু তো থাকত - রোজ দেখতে পেতাম। বাড়ির মেঝেতে পড়ে থাকা মেশিনটার দিকে তাকিয়েও সেই একই কথা ভাবলাম - তবু তো আছে, তবু তো দেখতে পাচ্ছি। মানুষ আর মেশিন চলে গেলে বোধ করি একই মন কেমন রেখে যায়। যাক। আজ বন্ধুকে বিদায় জানালাম। মুছে পরিষ্কার করে ওর যাওয়াটা সুন্দর করে দিলাম।'
অভিনেত্রী আরও লেখেন, ‘শ্মশানে যাওয়ার সময় আপনজনদের যেমন আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে গায়ে সুগন্ধী মাখিয়ে পাঠাই ঠিক তেমনি। আজ নতুনজন ও এলো।মাসি হাসি মুখে তাতে খাবার গরম করে দিতে এত বিস্বাদ লাগল যে পেট ভর্তি করে জল খেয়ে উঠে পরলাম। আকাশ থেকে তারা খসে পড়ার মতন মা এর কেনা জিনিসগুলো ও একটা একটা করে খসে পড়ছে। আহারে ফেলে দিই কেমন করে এই ভেবে, অকেজো জিনিস স্তুপাকার হয়ে বাড়িটা গুদাম ঘরে পরিণত হচ্ছে। এও আর এক লড়াই। এই লড়াই ও জিততে হবে। মায়া ত্যাগ করে মায়ের সংসার মুছে নিজের মতন করে সবটা গুছিয়ে নিতে হবে। মা মরে গেছে ১০ বছর হতে চলল, এখনও পারছিনা, আর কবে…’।