গত কয়েক ঘণ্টায় ফেডারেশন বনাম পরিচালক দ্বন্দ্ব বিরাট আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এমনই রবিবার কোনও সমাধান সূত্র না বেরোলে সোমবার থেকে তালাবন্ধ থাকতে পারে স্টুডিওপাড়া। কারণ শনিবার সকালে এসভিএফের ছবির সেটে টেকনিশিয়ানদের অনুপস্থিতির কারণ খুঁজে পাননি পরিচালকরা। এই ‘অপমান’-এর জবাবে পরিচালকরা জানিয়েছেন, যদি রাহুলে সসম্মানে পরিচালকের পদে টেকনিশিয়ানরা না গ্রহণ করে তবে সোমবার থেকে ছবি, সিরিয়ালের সেটে যাবেন না তাঁরা।
এর পরেও শনিবার সন্ধ্যায় ফেডারেশন নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। জানায়, রাহুল মুখোপাধ্যায়ের উপর থেকে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা পরিচালকের সংগঠন তুলে নিলেও, তাঁদের হাতে থাকা নথি অনুসারে এখনও ছবির পরিচালক শৌমিক হালদার। স্বরূপ এদিন জানান, ‘বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে’। রাহুল পরিচালকের আসনে থাকলে টেকনিশিয়ানরা শ্যুটিং করবেন? এই প্রশ্নের জবাবে স্বরূপ বিশ্বাস জানান, তাঁদের কাছে যে নথি আছে, সেখানে এসভিএফের ছবির পরিচালক সৌমিক হালদার, রাহুল মুখোপাধ্যায় নন। অর্থাৎ রাহুলকে বয়কটের সিদ্ধান্ত থেকে সরল না ফেডারেশন।
পরিচালকদের পাশে প্রযোজক সংগঠন, এল চিঠি
ফেডারেশনের দাদাগিরি নিয়ে পরিচালকদের পর এবার সরব হয়েছেন প্রযোজকরাও। চিঠি দিয়ে ডিরেক্টরস গিল্ডকে সমর্থন জানান প্রযোজকরা। এতে আরও খানিকটা চাপ বাড়ল স্বরূপ বিশ্বাসের।
কেন রাহুলকে বয়কটের সিদ্ধান্ত ফেডারেশনের?
বাংলাদেশি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির হয়ে 'লহু'র শ্যুটিং কলকাতায় শুরু করেন রাহুল। চারদিন কাজ হওয়ার পর শ্যুটিং বন্ধ হয়। ফেডারেশনের নিয়মের সঙ্গে মতের মিল হয়নি প্রযোজকদের। এরপর ফেডারেশনকে কিছু না জানিয়ে শুধুমাত্র ডিওপি নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ছবির বাকি কাজ শেষ করেন রাহুল। সেই নিয়েই যত্ত ঝামেলা।
পরিচালক সংগঠন তুলে নেয় রাহুলের উপর জারি ৩ মাসের নিষেধাজ্ঞা
সেই ইউনিটের সঙ্গে প্রায় ৪০-৪৫ জনের রুজিরুটি জড়িয়ে। কারুর কথা ভাবেননি রাহুল, অভিযোগ তেমনই। গিল্ডের তরফে পরবর্তীতে রাহুলকে চিঠি ধরানো হলে ক্ষমা চেয়ে নেন তিনি। পরে পরিচালকদের সংগঠন রাহুলের উপর তিনমাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলস্বরূপ এসভিএফের পুজোর ছবি পরিচালনা করতে পারবেন না রাহুল, এমনটা জানা যায়। পরে ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসারের আসনে পাঠানো হয় তাঁকে। পরিচালক হিসাবে নাম যোগ হয় শৌমিক হালদারের। কিন্তু শুক্রবার মিটিং করে রাহুলের উপর থেকে ব্যান তুলে নেওয়া নেয় পরিচালকদের সংগঠন।
ফেডারেশনের দাদাগিরি নিয়ে একজোট টলিউডের তারকারা
পরিচালক ও ফেডারেশনের দ্বন্দ্ব কিছুতেই মিটছে না। তৃণমূল মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস ফেডারেশন সভাপতি। স্বরূপের স্ত্রী তৃণমূল কাউন্সিলর। অনেকেই এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল বনাম তৃণমূলের লড়াই হিসাবেও দেখছেন। কারণ ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন তৃণমূল বিধায়ক রাজ চক্রবর্তী, তৃণমূল সাংসদ দেব।
শনিবার সমাজ মাধ্যমে রাহুলের সমর্থনে তথা টলিউডের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি পোস্ট শেয়ার করেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, অঙ্কুশ, যশ, নুসরত, রাজ চক্রবর্তী-সহ টলিউডের আরও অনেকে।
সেই পোস্টে প্রথমত বলা হয়েছে, ‘আজ সকালে টেকনিশিয়ান স্টুডিওয় বাংলা ছবি, টেলিভিশনের পরিচালকেরা ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের সামনে কিছু প্রশ্ন রেখেছে। বহু দিন ধরেই রাখছে, আজ ভঙ্গিটা আন্দোলনের। তার একটি বা অনেক কারণ রয়েছে। এই আন্দোলনের গোড়ায়, আগায়, সামনে, পিছনে, ডান দিক, বাঁ দিক, কোথাও সিনিয়র, জুনিয়র-সহ সমস্ত রকমের টেকনিশিয়ান, সিনে-শ্রমিকদের স্বার্থহানির এক ফোঁটা উদ্দেশ্য নেই। বিষয় সেটা নয়ই। বিষয় হল নীতির।’
এই বিষয়টির মধ্যে কোনও রাজনৈতিক রং লাগাতে ইচ্ছুক নন তারকারা। টলিউড একটা পরিবার, তাই এখানে বনাম বা ভার্সেস কোনও প্রশ্ন নেই। স্পষ্ট লেখা রয়েছে, ‘পরিবারটা বাংলা বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি। তাই যে কোনো রাজনৈতিক বনাম এর, অন্য যে কোনো ’বনাম' এর বাইরে এই আলোচনা।
পোস্টে আরও লেখা হয়, ‘পরিবারের কারও শরীর খারাপ হলে চিকিৎসক পরীক্ষা করাতে বলেন। নীতি নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তা হলে সকলে বসে সেই পরীক্ষাগুলি করেই নেওয়া উচিত। যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে হয়, তা হলে সবার মতামত নিয়েই চলতে হয়।’ পরিচালক, অভিনেতা থেকে শুরু করে লাইটম্যান সবার মতামত এখানে জরুরি।
বাংলা ছবির এই বেহাল দশার জন্য আঙুল তোলা হয়েছে ফেডারেশনের একরোখা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। বলা হয়েছে, ‘ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের জেরে গোটা ইন্ডাস্ট্রি যে ভাবে এক বড় আসন্ন বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা নানা রকম ঘটনা দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া যায়। বাইরের বিজ্ঞাপন না আসা, বাইরের ছবির কাজ না আসা। এ সবেরই পথ সরু হতে হতে বন্ধ হতে চলেছে। আজকের বেশি টাকা কাল যদি শেষ হয়ে যায়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে বিনোদন শিল্প বলে আর কিছু থাকবে না। এটা রকেট সায়েন্স নয়, কঠিন অঙ্ক নয়। একটু মাথা খাটালেই বোঝা যাবে।’ অদূর ভবিষ্যতে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তৈরি স্টুডিও আশির দশকের মতো গুদাম ঘরে পরিণত হবে বলেও আশঙ্ক্ষা প্রকাশ করা হয় ওই পোস্টে।
এদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দেবও বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক রঙ না লাগানোর। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকার টলিপাড়ার স্টুডিওর উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে, আর সেটা কাজ বন্ধ করে ফেলে রাখার জন্য করা হয়নি। আগামি দিনে এই জটের কোন সমাধান সূত্র বেরোয় সেটাই দেখবার!