সিংহলগ্না ছাড়লেন কেন?
আমি ৩৫/৩৬ বছর ধরে কাজ করছি। টেলিভিশনের শুরুর দিক থেকে রয়েছি। আমাকে কাজে নেওয়া মানে আমার এক্সিলেন্সকে কাজে লাগানো। সেটাই যদি না হয়, শুধু মাত্র ওদের নির্দেশ অনুযায়ী অ্যাকশন আর কাট বলার জন্য আমাকে নেওয়ার কোনও মানে হয় না। শুধু একটা ভালো শট নিলাম তা তো নয়, গল্পে, চিত্রনাট্যে, কাস্টে, যদি আমার ইনভলভমেন্ট না থাকে তাহলে সেই কাজের কোনও মানে হয় না। আমার মাথার ওপর যদি তিনটে লোক চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে মুশকিল। সেই কাজ না জানা লোক গুলো যদি আমায় অনবরত নির্দেশ দিতে থাকেন সেটা তো গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে অন্য যে কোনও কাউকে নিক। অনিন্দ্য সরকার কেন? শুধু নামটার জন্য?
আরও একটা কারণ হতে পারে, হাউসের হয়ত প্ল্যান করাই ছিল, আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিন/চার মাস তো কাজটা করিয়ে ব্যাপারটা রান করিয়ে নিই, তাতে সিরিয়ালটা দেখতেও সুন্দর হবে। এরপর যেই প্রজেক্টটা জমে যাবে তারপর যে কোনও কাউকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়া যাবে। সেই কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করল যাতে আমি নিজে থেকেই সরে যাই। ওরা খুব ভালো করে জানে এই লোকটা আত্মসম্মান খুইয়ে, এখানে পড়ে থাকবে না।
তাহলে বলছেন কর্পোরেট রুলের চোখ রাঙানিতে স্বকীয়তা হারাচ্ছে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি?
এখানে কেউ কারও জন্য একফোঁটা জায়গা ছাড়বে না। কেউ কারও হয়ে একটা কথাও বলবে না। সবাই নিজেদেরটুকু নিয়েই অসম্ভব সচেতন। হাউস আমায় কাজে নিয়েছিল। চ্যানেলের সঙ্গেও আমার কোনও বিরোধিতা নেই। চ্যানেল বলেছে, ‘তুমি খুব ভালো মাউন্টিং করে দিয়েছো। ভবিষ্যতে অন্য প্রজেক্ট হলে তোমায় ডাকব। আমরা আবার একসঙ্গে কাজ করব। ’ ইত্যাদি। কিন্তু কিছু এরিয়ার লোক থাকে যাঁদের জন্য সমস্যাটা মেটে না। এক গামলা দুধে একফোটা চনার মতো। এই লোক গুলো সব সময় গন্ডোগোল পাকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। এবং ইন্ডাস্ট্রির কাজ জানা, পোড় খাওয়া লোকদের এঁরা ভয় পায়। কারণ যে গুলো করে ওঁরা এতদিন লাভবান হয়েছেন সেই চালাকি গুলো আমরা খুব সহজে ধরতে পারি। তাই শুরু থেকেই বিভিন্নভাবে ডিস্টার্ব করতে থাকে। চেষ্টা করে আমাদের ভিলেন প্রমান করার। আমার এক্সিলেন্স নিয়ে তো কিছু করতে পারে নি, তাই, আমি যেহেতু টেকনিশিয়ানদের পেমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম সেটা ইস্যু করল। কেন পেমেন্ট আসতে দেরি হবে, এই পরিস্থিতিতেও তো অন্য হাউসরা টাকা দিচ্ছে, তাহলে আমাদেরটা কেন নয়? যদি পারিশ্রমিক দিতে দেরি হয় তাহলে সেটা খুলে বলুক কতদিন সময় লাগবে। কিন্তু ওরা কিছুই জানায় নি। সবাই অন্ধকারে। রোজ তো নিজের প্রাপ্য টাকার জন্য ভিখারীর মতো ভিক্ষা চাওয়া যায় না!
আপনিও তাহলে ভিলেন প্রমাণিত হলেন সিংহলগ্নার ক্ষেত্রে?
(হাসি) এখন দেখা যায় বেশিরভাগ মেগা সিরিয়াল থেকে কয়েক মাস কাজ করার পর পরিচালক বাদ চলে যাচ্ছেন। কারণ এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে যে পরিচালক ভিলেন প্রতিপন্ন হচ্ছেন। বাধ্য হচ্ছেন সরে আসতে। অথচ সেই পরিচালকই ওই ধারাবাহিকের টিআরপি তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। আগে দেখা যেত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন পরিচালকের হাতেই থাকত সব দায় ভার। পরিচালকের নামে খ্যাতি পেত বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সব মাইলস্টোন ধারাবাহিক গুলো। যেমন, ‘কুয়াশা যখন’ যিশু দাশগুপ্তর সিরিয়াল। দেবাংশু সেনগুপ্তর সিরিয়াল ‘মহাপ্রভু’।অনিন্দ্য সরকারের সিরিয়াল ‘রামকৃষ্ণ’। এখনও লোকে জিজ্ঞেস করেন, কোন অনিন্দ্য? ‘আলোকিত এক ইন্দু’? এত বছর কাজ করে এটাই পাওয়া। মানুষ মনে রেখেছেন সেই সব কাজ। আর এখন অমুক হাউস, তমুক হাউস, বিভিন্ন ‘হাউসের নামে’ পরিচিতি পায় সিরিয়াল গুলো! ম্যাটারই করে না কে পরিচালক! কে লেখক, কার ক্যামেরা! আজকের পরিচালকদের কোনও স্বাধীনতা নেই। যতক্ষণ না পরিচালক তাঁর কর্ম ক্ষেত্রে স্বাধিনতা পাবেন ততক্ষণ সমস্যা থাকবেই। কিচ্ছু করার নেই।
আপনার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কারণেই সরে এলেন তাইতো?
১৮ মার্চ বন্ধ হয়েছিল সিংহ লগ্না-র শুটিং। আনলকের পর আমাদের চিত্রনাট্য লেখক পালটে গিয়েছে। যিনি নতুন এলেন তিনি তাঁর ক্রিয়েটিভিটি যোগ করে অন্যভাবে লিখতে শুরু করলেরন। আমি প্রথমেই বলেছিলাম এই ভাবে লেখক পরিবর্তন হলে সমস্যা হবে কারণ নতুন লেখক জানেন না এত দিন কীভাবে গল্পটা বলা হয়েছ, এবং গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্টাইলটা কেমন। লকডাউনের পর তো রাতারাতি গল্পের ধারাটা বদলে যেতে পারে না! এতে শুটিংয়ের সমস্যা হবে এবং সামঞ্জস্য হারিয়ে যাবে। শুটিং শুরুর দু'দিনের মধ্যেই যা ভেবেছিলাম সেটাই ঘটল। উনি যা লিখছেন তার সঙ্গে লকডাউনের আগের পার্টের কোনও মিল নেই! এবং যেভাবে লেখা হচ্ছে তাতে সময়ের মধ্যে শুটিং শেষ করা যাচ্ছে না।
যে বিধি নিষেধ মেনে কাজ শুরু হয়েছে তাতে এ ওকে ছুঁতে পারবে না, একে অপরকে ধরতে পারবে না, ফলে কোনও আবেগ ঘন সিন দেখানো যাবে না, কারণ বডি টাচ নেই, যা হচ্ছে সব ডিসনেন্স রেখে। ফ্লোরে লোক সংখ্যা কম। আউটডর করা যাবে না ইত্যাদি। আমি বলেছিলাম আপাতত এই সব সিন গুলো বাদ রেখে, ডোমেস্টিক বিষয় নিয়ে গল্প এগোতে। একটা বড় সিন ভেঙ্গে তিন ভাগে ভাগ করা হোক । তাতে কম চরিত্রের দ্বারা সিন গুলো এস্টাবলিশ করা যাবে। আর যেই ড্রামা গুলো এখন দেখানো যাবে না সেই গুলো তোলা থাক, তাতে আমাদের ব্যাঙ্কিংটা হবে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা সেই পার্ট গুলো একে একে আস্তিন থেকে বের করব। কিন্তু আমার কথা গুরুত্ব পেল না। সবাই বলল করে নেব, করে নেব। কিন্তু যেই শুটিং রানিং হল যথারিতি সমস্যা দেখা দিতে লাগল। যেহেতু এটা অ্যাপ্রুফড গল্প সেহেতু চ্যানেলের কাছে এটা বেদবাক্যের মতো। আমরা সেখান থেকে বিমুখ হতে পারছি না। কাজটা ওইভাবেই করতে হচ্ছে। এবং ওইভাবে করতে গিয়ে হয় কোয়ালিটি বজায় থাকছে না, নয় ফুটেজ উঠছে না। এত গুলো আর্টিস্ট তাঁদের বাদ রাখতে হচ্ছে, কাকে রাখব আর কাকে রাখব না এই নিয়ে হ্যাপাজার্ট সিচুয়েশন। এমন বিভিন্ন সমস্যা রোজ দেখা দিচ্ছে। এই বিষয় গুলো দেখার জন্য লোক রয়েছে। তাঁরা যদি ঠিক মতো নিজেদের কাজটা করতেন তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না।
চ্যানেল এবং হাউসের সঙ্গে মিটিং করেও তো এই সমস্যা মেটানো সম্ভব ছিল?
এই সব সমস্যা গুলোর জন্য প্রচুর মিটিং হয়। আলোচনা হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মিটিংয়ে কোনও পাকা সিদ্ধান্ত হয় না। ফাইনাল ডিসিশন মেকার কে? এই ভাবেই চলছে দিনের পর দিন। শুধু কফি খেলাম আর অ্যক্রস দ্য টেবিল প্রচুর বড় বড় কথা বললাম, টেলিভিশন টার্মোলজি নিয়ে লেকচার দিলাম, আমাদের লুক অ্যান্ড সিন, রিচ, আমাদের অমুক, তমুক ইত্যাদি। এই ভাবে চলে না। আল্টিমেটলি তো জিনিষটা তৈরি করতে হবে। একটা গাড়ির সাস্পেনশন, কার্বোরেটর এগুলো মেকানিকের বিষয়। যে চড়বে সে দেখবে গাড়িটা কেমন চলছে, বা কম্ফোর্টেবেল কিনা। দর্শকদের ক্ষেত্রেও তাই। তাঁরা দেখবেন ধারাবাহিকটা চলছে কেমন। কোনও জার্ক নেই তো, স্মুথ ভাবে চলছে তো? তাঁদের ভালো লাগছে কিনা। টেলিভিশন টার্মোলজি তাঁদের বিষয় নয়। ভেতরের সমস্যা তো আমরা দর্শকে দেখাতে পারি না, আমরা দেখব তাঁদের বিনোদন দিতে পারছি কিনা। আমি নিজেই যেখানে স্যাটিসফাইড নই, সেই প্রজেক্ট দর্শকদের দেখাই কেমন করে?
হাউসের মনোভাব সম্বন্ধে আপনার মতামত?
আমাদের সিংহলগ্নার একজন মেকআপ আর্টিস্ট কোভিড পজিটিভ হয়েছেন। যেদিন তিনি পজিটিভ হয়েছিলেন তার আগের দিনও তিনি মেকআপ করেছিলেন। অনেকেরই কাছাকাছি এসেছিলেন তিনি। তাহলে উচিত ছিল তিনি যাঁদের সংস্পর্ষে এসেছিলেন তাঁদের এবং বাইরে থেকেও যাঁরা সেদিন স্টুডিওতে এসেছিলেন যেমন খাবারের লোক, জলের লোক ইত্যাদি, তাঁদের সকলের একটা করে টেস্ট করা হোক প্রডাকশন হাউসের তরফ থেকে। এটা তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেটা করা হয় নি। আজ হয়ত বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ১০দিন পর কেউ এফেক্টেড হতেই পারে। এই পরিস্থিতিতে এতটা দায়িত্ব জ্ঞানহীনের মতো কাজ কীভাবে করতে পারে প্রডাকশন হাউস! অবাক হয়ে যাচ্ছি এই মানসিকতা দেখে! প্রথমে প্রডাকশন হাউস বিষয়টা লুকোতে চেয়েছিল। বলেছিল এমনি জ্বর হয়েছে তাই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরদিন তাঁর টেস্ট হয়। এবং কোভিড ধরা পড়ে। পরিস্থিতিটা কিন্তু জটিল, আর এর মধ্যে আমাদের কাজ করে খেতে হবে। বড্ড মুশকিল!
এই বিষয়ে চ্যানেল কিছু জানিয়েছে?
চ্যানেলের সঙ্গে কোনও সমস্যা হয় নি, এই হাউসটা মুম্বইয়ের। ব্যক্তিগত ভাবে হাউস আমায় চেনে না। কিন্তু কাজের জায়গা থেকে আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক হাউসের। মুম্বইয়ে যাঁরা বসে রয়রছেন তাঁরা বরাবরই আমার কাজের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু কলকাতায় যাঁরা এই হাউসটা চালাচ্ছেন, তাঁরা তো মিডল ম্যান, তাঁরাই মূলত সমস্যা করছেন। এঁরা কিন্তু কলকাতার সব বড় বড় ফেস, এই জোনটা তাঁরাই রিপ্রেজেন্ট করছেন। সমস্যা আরও অনেক বেশি হতে পারত, কিন্তু আমি সরে এলাম। তিক্ততা নিয়ে কাজ করা যায় না। আর এই বয়সে এসে এগুলো করার সময় বা ইচ্ছা কোনওটাই আমার নেই।
শুধু আমার সঙ্গেই নয়, অনেকের সঙ্গেই একই ঘটনা ঘটেছে। সিংহলগ্নার রচইতা সায়ন্তনী পুততন্ড। তিনি একজন রিনাউন্ড সাহিত্যিক। অনেক ভালো ভালো গল্প, কাহিনি রয়েছে এই লেখকের। একটা সময় এই গল্প নিয়ে হাউসের সেই সকল ফেসরা খুব হাইপার ছিলেন। বেশ একটা হাইপ তৈরি হয়েছিল। অথচ পরে একটা পরিস্থিতি তৈরি করে যাঁর গল্প তাঁকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হল। চিত্রনাট্য লিখছিলেন অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় তাঁকেও বাদ দেওয়া হল। অর্পিতার মাথার ওপর এত কিছু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল যে তাঁর পক্ষে শান্তিপূর্ণ ভাবে লেখা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন হাউস বলেছিল অর্পিতাকে নিয়ে হাউসের কোনও সমস্যা ছিল না, ওটা নাকি চ্যানেলে সিদ্ধান্ত। সংলাপ লিখছিল অর্ক সেনগুপ্ত তাঁকেও বাদ দিয়ে দিল, এই ভাবে পুরো টিমটাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের লোকজন ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু আমরা যখন এক সঙ্গে কাজটা শুরু করেছিলাম তখন নিজেদের মধ্যে সুন্দর একটা জেল ছিল, প্রত্যেকেই জানত গল্পটা কেমন ভাবে যাবে, কোন চরিত্রের কেমন শেড, সেটটা কেমন, ইত্যাদি। এগুলো না জানলে কখনওই চিত্রনাট্য তৈরি হয় না। আমি টিম ওয়ার্কে বিশ্বাসি। ফলে কাজটা মাত্রা পেয়েছিল। এখন হাউসের অঙ্গুলি হেলনে নতুন টিম কাজ করবে। কারণ ব-কলমে হাউসই তো পরিচালনা করছে সবটা! তাতে ধারাবাহিকের মান বজায় থাক, বা না থাক কিচ্ছু যায় আসেনা, কোনও রকমে ফুটেজ উঠলেই যথেষ্ট। জানিনা আর কত দিন এইভাবে যা খুশি তাই দেখিয়ে দর্শককে বোকা বানাবেন এঁরা!