মরু শহর আবু ধাবি-তে আইফা-র জমকালো আসর। তিনদিন ব্যাপী এই অ্যাওয়ার্ড সেরেমানি-তে শুরুর দিনে দক্ষিণের চার ইন্ডাস্ট্রির উদযাপন, দ্বিতীয় দিনে বলিউডের অ্যাওয়ার্ড নাইট। তামিল, তেলুগু ভাষা মতো আঞ্চলিক ছবির ইন্ডাস্ট্রির উদযাপন, অথচ বাংলার কোনও স্থা নেই।
সেই আসরে বাংলা তথা বাঙালির প্রতিনিধি টোটা রায় চৌধুরী। করণ জোহরের রকি অউর রানি-কি প্রেম কাহানিতে আলিয়া ভাটের বাবার চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ের সুবাদে সেরা সহ-অভিনেতা হিসাবে মনোনীত ছিলেন টোটা। পোশাকশিল্পী অভিষেক রায়ের ডিজাইন করা বন্ধগলা স্যুটে করণ-শাহরুখদের মাঝে পৌঁছেছিলেন টোটা।
পুরস্কার হাতে উঠেনি। অনিল কাপুরের কাছে হার শিকার করতে হয়েছে। অ্যানিম্যালের জন্য সেরা সহ-অভিনেতার পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছেন জক্কাস তারকা। কিন্তু শুধু পুরস্কার হাতছাড়া হয়েছে তাই নয়, এদিন বাংলা ছবির হৃত গৌরব নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখিও হন টোটা। নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাগ করে নিয়েছেন অভিনেতা।
আইফার গ্রিন কার্পেটে এক মহিলা সাংবাদিকের প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হন টোটা। কিন্তু হাল ছাড়েননি। অভিনেতার কথায়, ‘আইফা-তে ঢোকার মুখে প্রেস কর্নারে মুম্বাইয়ের এক মহিলা বাঙালি সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন যে IIFA তো দক্ষিণের চার ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অ্যাওয়ার্ড করছে। একসময় এই হিন্দি ইন্ডাস্ট্রিকে বাঙালিরাই পথ দেখিয়েছিল। এখন হিন্দি কোন সুদূরে এগিয়ে গেছে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সদস্য হয়ে আফসোস হয় না যে কেন IIFA বাংলা ছবি নিয়ে কোনো অ্যাওয়ার্ড শো করে না?’ দেখলাম প্রায় পঞ্চাশ জন সাংবাদিক, যে যা করছিলেন সেটা থামিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। হেডলাইটে হরিণ না হয়ে ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিলাম, ‘তাঁদের অগ্রগতি আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সবাই মিলে প্রচেষ্টা করব যাতে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা যায়।’ উত্তর শুনে কন্যা তখন মিটিমিটি হাসছেন। ভাবখানা এই যে, গুগলি দিলাম বটে তবে মন্দ খেললে না।'
প্রশ্ন-উত্তর পর্ব সেখানে মিটলেও এই প্রশ্ন কিন্তু ভাবিয়েছে টোটাকে। তিনি লেখেন, ‘রাতে ফিরে ডিনারের পর পায়চারি করতে করতে প্রশ্নটা ভাবালো। সত্যিই তো, একটা সময় আমরাই পথপ্রদর্শক ছিলাম। রায়, সেন, ঘটক-দের কথা ছেড়েই দিলাম। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘নিশিপদ্ম’ (অমর প্রেম) বা অগ্রদূত এর ‘ছদ্মবেশী’ (চুপকে চুপকে ) এর মত অনেক বাংলা ছবির হিন্দি রিমেক এক সময়ে ভারত কাঁপিয়ে ব্যবসা করেছে। এক দশক আগেও ঋতুদার, ঋতুপর্ণ ঘোষের, ছবিগুলো বহু ভাষাভাষীর দর্শক দেখতেন এবং সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। কোথায় আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতি হলো বা কি করলে পূর্বস্থান পুনর্দখল করতে পারি তা নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনার আশু প্রয়োজন। কবে ঘি খেয়েছি বা ঘি-চপচপে পোলাও বিতরণ করেছি সেটা বারংবার বমন করে বাকিদের বিরক্তির ও করুণার পাত্র হয়ে এক ইঞ্চিও অগ্রগতি হবে না।’
তাঁর আরও সংযোজন, ‘আমার মনে হয় গত দশ-বারো বছরে আমরা যেন চিন্তাধারায়, মানসিকতায় ও কর্মে খুবই ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ হয়ে উঠেছি। অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় প্রমাণিত করার দৌড়ে এটা ভুলে গেছি যে নিজেকে বৃহৎ করেও কিন্তু অন্যকে খর্ব করা যায়। অবশ্য দ্বিতীয়টি অপেক্ষাকৃত অনেকটাই কঠিন। সেটা করতে গেলে প্রথমেই ঈর্ষা ত্যাগ করে স্বীকার করে নিতে হয় যে প্রতিযোগীর কাজ তুলনায় উচ্চমানের। তারপরে উন্নতিসাধনে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা। সেগুলো করার প্রাথমিক শর্ত হলো সত্যের সম্মুখীন হওয়ার বাত্যার সাহস ও ব্যাপ্ত হৃদয়। আমাদের পূর্বসূরিদের হয়তো তাঁদের কিছু উত্তরসূরিদের মত জার্মান গাড়ি, সুইস ঘড়ি, ফ্রেঞ্চ পারফিউম, ইটালিয়ান স্যুট, গ্রিক ভ্য়াকেশন, বহুতলে দক্ষিণখোলা ছিল না কিন্তু মনখোলা, প্রাণখোলা ছিলেন বলে মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করতেন আর তাই আমরা তাঁদের মনেপ্রাণে স্থান দিয়েছি।’