রাহুল মজুমদার
সিনিয়র সাব এডিটর, আজকাল ডট ইন
এ লেখা ফরমায়েশি নয়। অন্ধভক্তের গদগদে লেখাও নয়, যার প্রতিটি বাক্যে তেলের ফোঁটা চুঁইয়ে পড়বে। এ লেখা উপলব্ধির, খানিক ফেলে আসা হেমন্তের মনকেমন করা বিকেলের মতো আমার কাছে।
আমি যখন হিন্দুস্তান টাইমস্ বাংলা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে ঢুকেছিলাম, সে বড় অদ্ভুত সময়। করোনার প্রকোপ তখন তুঙ্গে। আকাশ ঝকঝকে নীল, খাঁ-খাঁ পিচের রাস্তা ছুঁয়ে হাওয়া পাক খেলেও খসখসে শব্দ শোনা যেত, এমনকি বিকেলের রোদের রঙেও দিব্যি টের পাওয়া যেত কমলালেবু রং। কিন্তু চারপাশে ভয়ের অদৃশ্য কাঁটাতার। মৃত্যুভয়ের। তাই ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিমের টেবিলটাই হয়ে উঠেছিল হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে যোগাযোগ করার আমার 'মিডিয়াম'। কখনও বা সেটা পাল্টে হয়ে যেত ঘরের সোফায়। তবে এই নামী প্রতিষ্ঠানে কাজের কিছু মজা রয়েছে। আপাতত একটা বলি।
ঘরের মধ্যে ল্যাপটপ খুলে বসে কাজ করলেও সহকর্মীদের সঙ্গে চুটিয়ে ভার্চুয়ালি আড্ডা মারতে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি ঘরের দেওয়াল কিংবা আমাদের সম্পাদক অর্ঘ্য প্রসূন রায়চৌধুরী। 'বস' নয়, দাদা। অর্ঘ্যদা। বহুবার এমন হয়েছে 'নম্বর দেবে' এমন 'খবর' খোঁজার চাপে আমরা যখন নাজেহাল, হঠাৎ করেই হয়তো জরুরি মিটিং ডেকে বসল অর্ঘ্যদা। আমরা শিওর, ফোনের ওপ্রান্ত থেকে এবার হয়তো মিঠে-কড়া ভাষায় মৃদু লাঠিচার্জ হবে সবার সামনে। কিন্তু মিটিং শুরু হতেই সে চিন্তা তখন ময়দানে। আড্ডা-হাসি ভাগ করে অর্ঘ্যদা-ই তখন আমাদের চাঙা করার দায়িত্বে থাকা 'ফিজিশিয়ান'। ওই পেটেন্ট আড্ডাগুলোর স্বাদ একান্তই 'হিন্দুস্তানি'। এই ফাঁকে আরও একটা কথা টুক করে বলে ফেলি, যা অত্যন্ত জরুরি। আমি খবরের যে বিটে ছিলাম, সেই ডিপার্টমেন্টে আমার সহকর্মীরা সবাই মহিলা ছিলেন। কিন্তু কোনওদিনই তারা আমাকে সংখ্যালঘু হলে কেমন লাগে, সেই অনুভূতিকে ৫০...নাহ্ ১০০ মিটারের মধ্যে আসতে দেয়নি।
আলাপ হয়েছিল সুমনদার সঙ্গে। সুমন রায়। আনন্দবাজার থেকে উঁচু পদে এসে বসা এই সাংবাদিকের থেকে খানিক দূরত্ব-ই রেখেছিলাম প্রথমে। খানিক সম্ভ্রমে, খানিক পদের গুরুগম্ভীর ওজনে। কিন্তু সেই মানুষটাই তাঁর এই অধস্তন সহকর্মীকে কাজ শেখানো থেকে শুরু করে শব্দের ভাঁজ নিয়ে কারিকুরি করার গোপন রেসিপির সন্ধান দেওয়ার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। সুমনদার চোখে এটা হয়তো বা ছিল কর্তব্য কিংবা স্নেহ গোছের কিছু। কিন্তু আমার কাছে উত্তাল মাঝ দরিয়ায় একটা আস্ত লাইফবোট! প্রতিষ্ঠান বদলালেও সুমনদার সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরালো হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস্ বাংলা না থাকলে যে এই পাওনাটাও আমার কপালে জুটত না, তা বলার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। ইস্, সুমনদাকে কোনওদিন একথা বলা হয়নি। যাক্, একটু দেরি হল বটে, তবে আজ বলে দিলাম সবার সামনে।
হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা-কে জানি না কতটুকু দিতে পেরেছি, কিন্তু যা পেয়েছি দাঁড়িপাল্লার ওজনের ভার যে সেদিকেই বেশি ভারী তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই আমার মনে। সেইজন্য আজও মনের একটা অংশ তাই হয়তো রয়ে গিয়েছে 'হিন্দুস্তানি'।