বাঙালি জীবনে ‘বাঁশ দেওয়া’ একটি নেতিবাচক প্রবাদে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তবে বদলাচ্ছে সময়, বদলাচ্ছে পরিস্থিতি। বাড়ির আসবাবপত্র তৈরি হোক বা বাড়ি, কাঠ বা স্টিলের জায়গায় এবার বাঁশ ব্যবহার করার সময় হয়েছে আর এই ব্যাপারে রাস্তা দেখাচ্ছেন বাংলার দেবোপম মুখার্জি। শুধু ব্যবসা নয়, পরিবেশের ক্ষেত্রেও এর সরাসরি ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাঁশ এমন একটি ঘাস, যা অন্যান্য উদ্ভিদের থেকে ৩২ শতাংশ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয় প্রকৃতি থেকে। তাই বাঁশের ব্যবহার একদিকে যেমন যত্রতত্র গাছ কাটা কমাবে, তার সঙ্গে পরিবেশে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও সাহায্য করবে।
আদ্যপান্ত বাঙালি দেবোপম যিনি এই সময়ে কলকাতায় তার সংস্থা আর্টিসন এগ্রটেক-এর বিশেষ দুই দিনের প্রদর্শনীতে রয়েছেন, অকপটে বললেন, ‘বাঁশ দিয়ে বাড়ি তৈরি - প্রথমে যখন বলেছিলাম, সবাই হেসেছিল। আর এখন আমার শহরে এসে গিয়েছি, বাঁশ দিয়ে বাসা বানানোর রেসিপি বলছি সবাইকে। ভবঘুরের মতো অনেক দেশে গিয়েছি, অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে অনেক। আর তার সঙ্গে অনেক নতুন ভাবনাও। আজ আমরা যেটা ভাবছি বা যেই কর্মকাণ্ড শুরু করেছি, সেটি কিন্তু ট্রেন্ড হতে চলেছে সামনের দিনের জন্য। কাঠ নয়, বরং বাঁশ দিয়ে আসবাব হোক বা বাড়ি, এই হোক এগিয়ে চলা। প্রকৃতি বান্ধব এই পথ ইতিমধ্যেই জিরো কার্বন পৃথিবীর অন্যতম একটি প্রধান রাস্তা হতে চলেছে। আমাদের সংস্থা এগিয়ে চলেছে আমাদের দেশের অনেক চাষীবন্ধুদের নিয়ে। সামনের দিনে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও এই উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
Sustainable Economy সারা পৃথিবীতেই বেশ বহুল চর্চিত একটি শব্দ। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে, পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম এবং গুরুত্ব অনুধাবন করেছে সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাই। তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে Sustainable এর লাভজনিত ব্যাখ্যা নেহাৎ সহজ নয়, তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেকেই অগ্রসর হতে পারেন না। এখানেই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দেবোপম।
কলকাতার অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে দুই দশক আগে এক নামিদামি সংস্থা শহর জুড়ে হোর্ডিং দিয়েছিল ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’। সবাই সব বোঝেন, কিন্তু গাছ কাটা বাড়তেই থাকে, জঙ্গল সাফ হতেই থাকে, বনের হাতি, বুনো শুয়োর, কাঠবেড়ালি থেকে হরিণ, সবাই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে আসে খাবারের জন্য। দেবোপমের এই ব্যবসায়িক প্রেসক্রিপশন কিন্তু ইতিমধ্যেই কাজ দিয়েছে ভারতের অনেক রাজ্যে। ২০০৮ সালে এই সংস্থা তৈরি করেন দেবোপম এবং জার্মানিতে পরবর্তী তিন বছর গবেষণা করেন পুরো পদ্ধতি নিয়ে। মধ্যপ্রদেশের খান্ডাওয়াতে যাত্রা শুরু হয় দেবোপমের। ২০২০ সালে মধ্যপ্রদেশের দিয়াসে বিশ্বের প্রথম প্রসেসড ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাম্বু বোর্ড ফ্যাক্টরি তৈরি করে আর্টিসন এগ্রটেক। এই বছর ইতিমধ্যেই বাড়ি বানানোর দিকেও এগিয়ে গিয়েছে দেবোপম। সামনের দিনে কলকাতাতেও নিজের কর্মকাণ্ড নিয়ে এগোচ্ছে আর তার সঙ্গে সুন্দরবনের নোনা জলে বাঁশ গাছ নিয়ে কীভাবে নতুন উদ্ভাবন আনা যায়, সেই নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে দেবোপম ও তার টিমের।
বাঁশ নিয়ে বাড়ির অনেক সুবিধা, ভূমিকম্পের সঙ্গে যুজে থাকার লড়াই হোক বা ঠান্ডা রাখা, সবেতেই অক্লেশে সাফল্য বাঁশের ঘরের। তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা স্রেফ গল্প ছিল না, তা আজকের ক্রিপ্টোকারেন্সির যুগেও যে চলনসই, তা দেখিয়ে দিচ্ছেন দেবোপম। তাই অনেক আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয় নিয়ে বাংলার দেবোপম জানালেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই ঠিক করেছি যে যেই সমস্ত চাষী আমাদের বৃহৎ কর্ম কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাদের আমরা প্রতি অর্থবর্ষে প্রতি ছয় মাসে দুই বার করে বোনাস দেওয়া হবে সংস্থার মোট মুনাফার ২৪ শতাংশ থেকে। এছাড়া আমরা লক্ষ্য রেখেছি যে কীভাবে আরও স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে যুক্ত করা যায় আর আরো মহিলাকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় আমাদের কাজের মধ্যে। ২০২৪ সালের মধ্যে ১ কোটি বাঁশ গাছের চারা লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছি। আমরা সকলেই জানি যে ভারত সারা বিশ্বের ১৬ শতাংশ আসবাব আমদানি করি। অর্থাৎ আসবাবের ক্ষেত্রে আমরা চিনের মতো দেশের উপর নির্ভরশীল। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ -র কথা বলেছেন, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের আর্টিসন এগ্রটেক। তাই আমরা শুধু যে ব্যবসায়িক লাভ দেখছি এমন নয়, তার সাথে দেশের ভালোর কথা ভাবছি। আমার স্বপ্ন যে একদিন ভারত বাঁশ দিয়ে আসবাব বা বাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীকে পথ দেখাবে।’