রণবীর ভট্টাচার্য
বিজ্ঞানের পৃথিবীতে সুইজারল্যান্ডের সার্নের (CERN) কথা সকলেই জানেন। শুধু ঈশ্বরকণা বা God Particle নিয়ে গবেষণাই নয়, বরং পরমাণু কিম্বা সামগ্রিক ভাবে বিজ্ঞান নিয়ে গঠনমূলক গবেষণার ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতেই বিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠান। সদ্য সমাপ্ত হওয়া সার্ন ইন্টারন্যাশনাল টিচার প্রোগ্রাম ২০২২ (CERN International Teacher Programme) এ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে এল কলকাতার মেয়ে অপূর্বা সরকার। ৩৪টি দেশ থেকে ৪৩ জন শিক্ষক শিক্ষিকাদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য। সার্নের ইতিহাসে অপূর্বা ১৩তম ভারতীয় যে এই সুযোগ পেল। বলাই বাহুল্য, এই বছর ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি ছিল অপূর্বা, স্কুল জীবন থেকেই অসম্ভব প্রতিভাবান এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পারদর্শী।
স্নাতক স্তরে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং স্নাতকোত্তর স্তরে আইআইটি মাদ্রাজে সাফল্যের সাথে উচ্চশিক্ষার দিকে এগোয় অপূর্বা সরকার। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে অধিক নাম্বার পেয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট অপূর্বা পাড়ি দেয় সুদূর জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ডাইনামিক্স এবং সেলফ অর্গানাইজেশনে গবেষণার জন্য। গড়পড়তা ছাত্র-ছাত্রীর মত ডিগ্রির পিছনে দৌড়ানোর লড়াইয়ে কোনদিন ছিল না অপূর্বা। তাই গবেষণার মাঝপথেই দেশে ফিরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত করে সে। তারপর আট বছর বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সেবায় এগিয়ে যায়। মুম্বাইয়ের ধীরুভাই আম্বানি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে অতি সম্প্রতি বিরতি নিয়ে নতুন করে গবেষণার কাজে এগোনোর দিকে অপূর্বা। এই জন্য আবার বিদেশ পাড়ি দেবে সে। ‘পড়াশোনা স্রেফ নাম্বার বা মার্কস বা ডিগ্রি কেন্দ্রিক মনে হয় না আমার। কোথাও না কোথাও ভালোলাগা থাকা খুব দরকার। না হলে, নিজেকে মোটিভেট করা সহজ নয়,’ জানায় অপূর্বা।
সার্নের এই সম্মেলন তথা ওয়ার্কশপে সেরার সেরা শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্য ছিল দুর্দান্ত বৈজ্ঞানিক আয়োজন। সার্নের পার্টিকেল ফিজিক্স এবং ইঞ্জিনিয়াররা একাধিক সেশনে নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আলোচনা করেছেন। ঘটনাচক্রে হিগস বোসন আবিষ্কারের দশতম পূর্তির উদযাপন হয় এই সময়েই। সার্নের সিনক্রসাইকলোট্রন (Synchocyclotron), সিএমএস (CMS), সার্ন ডেটা সেন্টার (CERN Data Center), সার্ন কন্ট্রোল সেন্টার (CERN Control Center) এর মত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিভিন্ন আঙ্গিক ঘুরে দেখানো হয় আমন্ত্রিত শিক্ষক শিক্ষিকাদের। এই অভিজ্ঞতা যে কোন শিক্ষক শিক্ষিকা বা বৈজ্ঞানিকের কাছেই দুর্মূল্য, বিশেষ করে গন্তব্য যখন সার্ন!
ভারতের মতো দেশে যেখানে এখনও অনেক পরিবারে বাড়ির মেয়েদের বিজ্ঞান বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয় কিংবা অনুপ্রেরণায় ঘাটতি থেকে যায়, সেখানে অপূর্বা সরকার উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে অপূর্বা রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন টিচার পুরস্কার পেয়েছিল অপূর্বা। এছাড়া মাইক্রোসফট ইনোভেটিভ এডুকেটর এক্সপার্ট, অ্যাডব ক্রিয়েটিভ এডুকেটর এবং মাইক্রোসফট সার্টিফায়েড এডুকেটর হিসেবে পড়ুয়া মহলে ভীষণ জনপ্রিয় অপূর্বা। সাহিত্যে কিম্বা সিনেমার কোনীর একজন ক্ষিদ্দার দরকার ছিল। কিন্তু ক্ষিদ্দা কি পুরুষ না হয়ে মহিলা হলেও কোনী আকাশছোঁয়া সাফল্য পেত? অপূর্বর মত উদাহরণ কিন্তু নতুন করে ভাবতে সেখানে অবশ্যই। ভারত কিন্তু অপেক্ষায় থাকবে অপূর্বা যেন গবেষণা কেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষার পর আবার দেশে ফিরে আসবে। নতুন ভারত গঠন করতে গেলে শুধু প্রতিভা নয়, প্রতিভার পরিচর্যার জন্য সুযোগ্য মাস্টারমশাই চাই। লিঙ্গ বৈষম্য ফুৎকারে ভেঙে এগিয়ে চলা একাধারে বৈজ্ঞানিক আরেকদিকে শিক্ষিকা অপূর্বা কিন্তু নতুন ভারতের মাস্টারমশাইয়ের সেরা উদাহরণ হতেই পারে সামনের দিনে।